৩০ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:৩৯

ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়ালের দুর্নীতি দেখে হতবাক সংসদীয় কমিটি

দুই ব্যাংকে ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি

অস্তিত্ববিহীন সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দিয়েছে * ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা * ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করেছে, তা পড়লেই গা শিউরে ওঠে, এর দায় পরিচালনা পর্ষদকে নিতে হবে : ড. আবদুর রাজ্জাক
অস্তিত্বহীন সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। পরিচালকদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি এবং খেলাপি গ্রাহককে বারবার ঋণ দেয়ার অনেক নজিরও রয়েছে। ব্যাংকটি আর্থিক খাতে ‘সিস্টেমেটিক রিস্ক’ সৃষ্টি করছে। একইভাবে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও সীমাহীন অনিয়ম হচ্ছে। অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল এবং বেনামে শেয়ার কেনাসহ ঋণ জালিয়াতির ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। রয়েছে জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের বিস্তর অভিযোগ। নতুন এই দুই ব্যাংকের ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখে হতবাক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তারা ব্যাংক দুটির সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। দায় পরিশোধের সক্ষমতাও হারিয়েছে ফারমার্স ব্যাংক। পাশাপাশি দুটি ব্যাংকের বিরুদ্ধেই আগামী দু’মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। বৈঠকে কমিটির সদস্যদের মধ্যে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, নাজমুল হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, শওকত চৌধুরী এবং আখতার জাহানসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যাংকগুলো যেসব অনিয়ম করেছে, তা পড়লেই গা শিউরে ওঠে। এসব অনিয়মের দায় পরিচালনা পর্ষদকে নিতে হবে। তারা এ অনিয়মের দায় এড়াবে কিভাবে?’ প্রভাবশালী চেয়ারম্যানের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো পায়ই।’ কমিটির সভাপতি আরও বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংক হলেও এটা পাবলিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের টাকায় চলে। সে জন্য কমিটি এ বিষয়ে আলোচনা করেছে।’ সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি একেএম শামীম উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে সভাপতি বলেন, ‘তিনি বলেছেন, এমডি হিসেবে তার আসার আগে এগুলো হয়েছে। তারা সংশোধনের চেষ্টা করছে।’
বৈঠকে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সভাপতি ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘আমরা যেটা দেখেছি সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংক অ্যাগ্রিসিভ লোন দিচ্ছে। এ বিষয়টি আমরা সতর্ক করেছি।’ বৈঠক সূত্র জানায়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনেও ব্যাংক দুটি সম্পর্কে উদ্বেগজনক তথ্য জানানো হয় সংসদীয় কমিটিকে। বিশেষ করে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ফারমার্স ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই। সাধারণ আমানতকারী ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে অর্থ নিয়ে বর্তমানে এর কার্যক্রম চলছে। এ কারণে ব্যাংকটির ওপর আমানতকারীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে। বৈঠকে এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা না মেনে নতুন করে ঋণ দিয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এ ছাড়া এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ডসভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী করা হয়েছে। নিয়ম ভেঙে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন সংগ্রহে অনিয়ম, প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিবর্তে বেনামে বাংলাদেশে বসবাসকারী ব্যক্তিকে দিয়ে ব্যাংকের শেয়ার কেনা হয়েছে। বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়াসহ ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এর সঙ্গে পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৩ সালে তাদের কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ফারমার্স ব্যাংকে ঋণ প্রদানের নিয়ম-কানুন মেনে চলা ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় শিথিলতা দেখা দেয়। প্রথম থেকেই নীতিমালা অনুসরণ না করে অনেক গ্রাহককে ঋণ দেয়া হয়েছে। অস্তিত্বহীন এবং সাইন বোর্ডসর্বস্ব বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকেও ঋণ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ প্রদানের নিয়ম লঙ্ঘন করে ব্যাংকের পরিচালকসহ অন্য ব্যাংকের পরিচালকরাও ঋণ নিয়েছেন। অপর্যাপ্ত/ত্রুটিপূর্ণ জামানতের বিপরীতেও ঋণ দেয়া হয়েছে। ঋণগ্রহীতার সর্বোচ্চ ঋণসীমা না মেনে অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ ছাড়া খেলাপি গ্রাহককে পুনরায় ঋণ প্রদান, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম, পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীর তথ্যে নানা ধরনের অস্পষ্টতা এবং অসঙ্গতি, প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ঋণ পুনঃতফসিল, নির্ধারিত মেয়াদের অতিরিক্ত মেয়াদ অনুমোদন, অন্য ব্যাংকের নিন্মমানের ঋণ গ্রহণসহ নানাবিধ অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে জুনে লাইসেন্স পায় ফারমার্স ব্যাংক। একই সময়ে আরও আটটি ব্যাংক লাইসেন্স পায়। যা রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এর আগে তার স্ত্রী ছিলেন এ পদে। শত শত কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়ম ধরা পড়ায় ২০১৬ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছর ধরে ফারমার্স ব্যাংকে তারল্য সংকট রয়েছে এবং বর্তমানে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যাংকটি ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১৭ তারিখে ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্তঃব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে কলমানি ঋণের পরিমাণ ১৪৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ক্রয়কৃত সরকারি সিকিউরিটিজের (বিল ও বন্ড) পরিমাণ ১ হাজার ৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির দায় পরিশোধের সক্ষমতা নেই।
নতুন ঋণ মঞ্জুরি ও ঋণসীমা বাড়ানোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফারমার্স ব্যাংক তা না মেনে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়- জুন, ২০১৭ ত্রৈমাসিকে ঋণ প্রবৃদ্ধি আমানত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় ঋণ-আমানত হার দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। যা সর্বোচ্চ গ্রহণসীমার ৮৫ শতাংশ অপেক্ষা বেশি। ব্যাংকটির ওপর দণ্ড সুদ ও জরিমানার পরিমাণ গত এক বছরে দাঁড়িয়েছে ১৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এ ছাড়া ব্যাংকটির মোট ৫৪টি শাখার মধ্যে ২৮টি শাখাই লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে।

অপরদিকে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ডসভায় অনুপস্থিত পরিচালকদের স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিতি দেখিয়ে পর্ষদ সভার কার্যবিবরণী করা হয়েছে। ব্যাংকটি গঠনের সময় মূলধন সংগ্রহে বড় ধরনের অনিয়ম করা হয়। এ ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ প্রদান এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির সঙ্গে পর্ষদ সদস্য ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোম্পানি আইনের বিধান এবং ব্যাংকের আর্টিক্যালস অব অ্যাসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট ধারা লঙ্ঘন করে ব্যাংকের একজন পরিচালকের অনুপস্থিতিতে তার শেয়ার হস্তান্তরের বিষয়ে পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এমনকি নিয়ম না মেনে ৬ জন পরিচালকের শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ ও ৩ জন পরিচালককে অপসারণ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ডিসেম্বর ২০১৬ প্রান্তিকে প্রায় ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু জুন ২০১৭ প্রান্তিকে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ১৭২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ১৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। নতুন স্থাপিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণের হারের বিবেচনায় ব্যাংকটির অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ফারমার্স ব্যাংক রয়েছে প্রথম অবস্থানে।
এদিকে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক পরিচালনায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে অধিকতর তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করাসহ ব্যাংকগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে বৈঠক থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
বৈঠকে জানানো হয়, এবি ব্যাংকের যোগসাজশে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে। প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ৪টি বিদেশি ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটকে তথ্য দেয়ার অনুরোধ করেছে। যার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী বৈঠকে কমিটিকে জানানো হবে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/30/167447