২৯ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৮

হাসপাতাল ওদের কাছে জিম্মি

কর্মীদের বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট

বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আইসিইউ চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়াকে দায়ী করা হয়। হিরনের মৃত্যুর পরপরই দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী প্রায় দেড় বছর আগে সেখানে আইসিইউ ও সিসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হয়। কিন্তু দুই কর্মচারীর বাধার কারণে সেটা চালু করতেই কয়েক মাস কেটে যায়।

প্রায় তিন মাস আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম হাসপাতালে গিয়ে ওই আইসিইউ ও সিসিইউ ইউনিট উদ্বোধন করেন। তবে ওই দুই কর্মচারীর বাধার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখনও যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া বিল প্রদান করতে পারেনি। শুধু এই হাসপাতালের নয়। দেশের প্রধান সব হাসপাতালেই রয়েছে এ রকম সমস্যা। হাসপাতাল কর্মীদের বাণিজ্যিক সিন্ডিকেটের কারণে সবখানেই ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা। বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি।

শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. এসএম সিরাজুল ইসলাম গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত এক চিঠিতে সেখানকার পুরো বিষয়টি উল্লেখ করে দুই কর্মচারীকে অন্যত্র বদলির অনুরোধ করেন। পরিচালকের চিঠিতে বলা হয়, বরাদ্দকৃত অর্থ পরিশোধের জন্য মালপত্র সার্ভে বোর্ড কর্তৃক গৃহীত হওয়ার পর স্টোরের দায়িত্বে থাকা অফিস সহকারী পরিতোষ সরকারকে রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা এবং হিসাবরক্ষক শহিদুল ইসলাম হাওলাদারকে বিল প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কর্মচারীদ্বয় নিজ নিজ দায়িত্ব পালন না করে যোগসাজশে বিল পরিশোধে বাধা সৃষ্টি করেন, যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের শৃঙ্খলা পরিপন্থী। হাসপাতালের সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুই কর্মচারীকে অনতিবিলম্বে অন্যত্র বদলির অনুরোধ করেন পরিচালক।

জানতে চাইলে ডা. এস এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিলটি পরিশোধ করার জন্য তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই কর্মচারী স্থানীয় কিছু ঠিকাদার ও প্রভাবশালীর যোগসাজশে বিল পরিশোধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। এ কারণে বিলটি পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।

হাসপাতাল পরিচালকের ওই চিঠির পরও ওই দুই কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জানা গেছে, ওই দুই কর্মচারী উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবির করে বদলির বিষয়টি স্থগিত করে রেখেছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অফিস সহকারী, স্টোরকিপার, ওয়ার্ড মাস্টারসহ এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারী হাসপাতালগুলোকে তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তিন বছর পর পর কর্মস্থল থেকে বদলির নিয়ম থাকলেও তারা আছেন বছরের পর বছর ধরে। দীর্ঘ ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে একই কর্মস্থলে থাকার কারণে স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, প্রভাবশালী ঠিকাদারদের ছত্রছায়ায় তাদের দৌরাত্ম্য নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাদের কাছে অসহায়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুলনা বিভাগীয় পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) পদে ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন ফরিদ আহমেদ। অনিয়ম, দুর্নীতি ও বদলি বাণিজ্যের কারণে প্রায় এক বছর আগে স্থানীয় এমপি তাকে বদলির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ডিও লেটার দেন। এরপর তাকে অন্যত্র বদলিও করা হয়। পরে উচ্চ পর্যায়ে লবিং-তদবির করে তিনি আবারও ওই পদে ফেরত গেছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাকির হোসেনকে অন্যত্র বদলির জন্য স্থানীয় এমপি সৈয়দা সায়রা মহসিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে ডিও লেটার দেন। এরপর তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জিল্লুর রহমান, বাবুল মিয়া, আবুল হোসেন ও সিরাজুল ইসলাম নামে চারজন ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান প্রায় ১৫ বছর ধরে এই পদে আছেন। অন্যরা ৪-৫ বছর ধরে কাজ করছেন। তাদের ছত্রছায়ায় ইমন, মালা, রাসেল, ফরিদা, রহিমা, সামাদ, সাহেরা, শিল্পীসহ শতাধিক স্পেশাল আয়া সিট বাণিজ্য ও রোগী বাগিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে নেওয়ার কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তারা বলেন, কোনো কুচক্রী মহল তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। হাসপাতালে সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাতে তারা কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করেন।

মিটফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার আবদুর রব কবিরাজ, সাজ্জাদ হোসেন, মোহাম্মদ ইহছাক, আবদুর রাজ্জাকের ছত্রছায়ায় রানী, বেগম, কুলসুম, রুবেল, ওয়াসিম, রনি, অনু, তনু, রেহেনা, রেণু বেগম, শামসুন্নাহার বেগম, সাথী বেগম, রোকসানা খাতুন, রহিমা বেগম, হোসনে আরা বেগমের নেতৃত্বে শতাধিক দালাল সিট বাণিজ্য ও প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী বাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওয়ার্ড মাস্টার ও দালাল চক্রের যোগসাজশে মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে পার্শ্ববর্তী মুনলাইট, বাঁধন, ইস্টার্ন ডায়গনস্টিক সেন্টার, আল-আরাফাত, ডক্টরস, ঢাকা হাসপাতাল, নিউ ঢাকা মডার্ন, আলফা ক্লিনিক, ডায়মন্ড ও কেজি হাসপাতালে রোগী বাগিয়ে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীপ্রতি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন দেন।

রাজধানীর শ্যামলী আড়াইশ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০১০ সালের ৬ জুন থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে মোস্তফা সেলিম খান এবং ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়ার্ড মাস্টার পদে মো. সৈকত হোসেন কর্মরত রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্টোরকিপার পদে ১৯৭৯ সালের ৮ মে থেকে নূর মোহাম্মদ আলী এবং ১৯৯৮ সালের ২২ জুন থেকে মো. আমির হোসেন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নাজমুল হক সিদ্দিকী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে মাহমুদ-উজ জামান ও ওয়ার্ড মাস্টার পদে বাহার উদ্দিন এবং মো. হামিদুল হক কর্মরত রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে একই কর্মস্থলে চাকরি করছেন।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে আরিফ হোসেন ও মিজানুর রহমান, স্টোরকিপার পদে কামরুল ইসলাম চৌধুরী, ওয়ার্ড মাস্টার পদে আমিরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম কর্মরত রয়েছেন। ২০০১ ও ২০০৩ সাল থেকে তারা একই কর্মস্থলে কাজ করছেন।

জাতীয় অর্থোপেডিক পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) ও হাসপাতালে স্টোরকিপার পদে আবু বকর সিদ্দিকী ও মো. আহসান উল্লাহ, ওয়ার্ড মাস্টার পদে মো. আবদুস সবুর, মো. দৌলত জামান এবং নজরুল ইসলাম কর্মরত রয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সাল থেকে একই কর্মস্থলে কাজ করছেন।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার জাকির হোসেন, হিসাবরক্ষক কাজী মুরাদ এবং স্টোর অফিসার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। তারা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছেন এই হাসপাতালে। এ ছাড়া রাজধানীর ক্যান্সার হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শিশু হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট. নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্টোরকিপার ও ওয়ার্ড মাস্টাররা কর্মরত রয়েছেন।

তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ সরেজমিন এবং সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালে কর্মরত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা. স্টোরকিপার ও অফিস সহকারীরা ঠিকাদারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, ওষুধ ও পথ্যবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকে সরকারি হাসপাতালের ওষুধ চুরি করে বিক্রির সঙ্গেও জড়িত। কেনাকাটার সমস্ত কাগজপত্র হিসাবরক্ষকের তত্ত্বাবধানে এবং ক্রয় করা সামগ্রী স্টোরকিপার ছাড়া হাসপাতালে প্রবেশের সুযোগ নেই। স্থানীয় সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা হাসপাতালগুলোতে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।

অপরদিকে সিট বাণিজ্য, রোগী বাগিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো, পথ্য বাণিজ্য থেকে শুরু করে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ে হাসপাতালের অনিয়ম-দুর্নীতির অগ্রভাগে থাকেন ওয়ার্ড মাস্টাররা। তাদের নেতৃত্বেই হাসপাতাল ও এরপর পার্শ্ববর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। চিকিৎসক-কর্মকর্তারাও তাদের সমীহ করে চলেন। দালাল চক্রের কাছ থেকে কমিশন নিয়ে ওয়ার্ড মাস্টাররা প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকে রোগী বাগানোর কাজ করেন। দরিদ্র রোগীরা এসব দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে।

বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের অন্তত পাঁচজন পরিচালক সমকালকে জানান, স্থানীয় সন্ত্রাসী ও ঠিকাদার চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে চিকিৎসক-কর্মকর্তারাও উল্লেখিত কর্মী সিন্ডিকেটকে সমীহ করে চলেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অবহিত করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, সামরিক শাসনামলে হাসপাতালে কর্মচারীদের বদলি না করার বিষয়ে একটি আইন করা হয়েছিল। তবে আদালত সামরিক শাসনামলে জারি করা সব আইন অবৈধ ঘোষণা করায় তা এখন আর কার্যকর নেই। ওই আইন থাকাকালে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কিংবা কেউ স্বেচ্ছায় বদলি হতে চাইলে তা করা হতো।

একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন কোনো কর্মচারীকে রাখা উচিত নয় জানিয়ে মহাপরিচালক আরও বলেন, শৃঙ্খলার স্বার্থেই চিকিৎসকদের মতো অন্য কর্মীদের একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কর্মস্থল বদলি করা প্রয়োজন। এতে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হবে।