২৯ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:০৬

উপদেষ্টারাই চালাচ্ছেন বীমা কোম্পানি

সাবেক এমডিরাই বসছেন উপদেষ্টার পদে, সব কাজ চলে তাদের কথায় * নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ বলছে, এটি সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়

বীমা খাতে চলছে উপদেষ্টাদের রাজত্ব। মূলত তারাই চালাচ্ছেন গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সসহ বেশ কয়েকটি বীমা কোম্পানি। কোনো কোনো কোম্পানিতে উপদেষ্টাদের অনুমতি ছাড়া একজন পিয়নও নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপদেষ্টারা বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেন। বোর্ড মিটিংয়ে অংশ না নিলেও তাদের মতামতের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত পাস হয় না। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো কোম্পানিতে আবার পদ পরিবর্তন করে এদের পরামর্শক হিসেবে দেখানো হয়। উপদেষ্টা বা পরামর্শকদের জন্য কোম্পানিতে বসার আলাদা রুমও রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাবেক এমডিদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সূত্র বলছে, এমডি হিসেবে বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়ায় তারা নিয়মিত চাকরি করতে পারেন না। এরপরই তাদের উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতা কমে না। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটিই (আইডিআরএ) এ ক্ষেত্রে অনেকটা অসহায়। সংস্থাটি বলছে, বীমা কোম্পানিগুলোর এ ধরনের কার্যক্রম এ খাতে কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। একই কথা বলছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা।

আইডিআরএর সদস্য গকুল চাঁদ দাস যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কাজ অবশ্যই কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। কারণ উপদেষ্টা বা পরামর্শক কারও বোর্ড মিটিংয়ে থাকার অনুমোদন নেই। বোর্ড মিটিংয়ে শুধু এমডি থাকতে পারেন। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বোর্ডে থাকবেন এমডি কিন্তু ক্ষমতা থাকবে উপদেষ্টার হাতে- এটি ঠিক নয়। তিনি বলেন, বীমা আইনে উপদেষ্টা নিয়োগের একটি ধারা আছে। কিন্তু এর আলোকে প্রবিধিমালা বা গাইডলাইন তৈরি হয়নি। ফলে আইডিআরএ এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। তার মতে, একটি নিয়ম করে দেয়া উচিত, কোনো কোম্পানির এমডি থাকলে অন্তত পরের দুই বছর বীমা খাতে অন্য কোনো চাকরি করা যাবে না।

বীমা খাতে কোনো কোম্পানির এমডি (মুখ্য নির্বাহী) হিসেবে চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬৭ বছর। এরপর কাগজে-কলমে তারা অবসরে গেলেও উপদেষ্টা বা পরামর্শক হিসেবে থেকে যান ওই কোম্পানিতে। কিন্তু মূলত তাদের নির্দেশেই কোম্পানির সব কাজ পরিচালিত হয়। পরামর্শক নিয়োগের সুবিধা হল এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইডিআরএ বা অন্য কারও অনুমতি লাগে না। সূত্র বলছে, সাধারণ বীমা খাতের অন্যতম কোম্পানি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক এমডি ছিলেন নাসির এ চৌধুরী। কয়েক বছর আগে তিনি অবসরে যান। পরে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান ওই কোম্পানিতে। শর্তপূরণ না হলেও এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তার মেয়ে ফারজানা চৌধুরীকে। কিন্তু কোম্পানিতে নাসির এ চৌধুরীর সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পায়। প্রাইম লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক এমডি ছিলেন কাজী মো. মোরতুজা আলী। বর্তমানে তিনি একই কোম্পানির প্রধান পরামর্শক। তার সিদ্ধান্তই প্রতিষ্ঠানের শেষ কথা। কোম্পানির কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টের তালিকায়ও এমডির পরই রয়েছে তার নাম। একইভাবে ফেডারেল ইন্স্যুরেন্সের সাবেক এমডি একেএম সারওয়ার্দী চৌধুরী। গত বছর তার বয়স ৬৭ বছর পার হয়। এমডি থাকাকালে বোর্ডের কাউকে পাত্তা দিতেন না তিনি। শিগগিরই তিনি কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন। বর্তমানে তার ফাইল আইডিআরএ অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ ছাড়া মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন কোম্পানির সাবেক এমডি নুরুল হক।

পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সাবেক এমডি বর্তমানে উপদেষ্টা সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের (বিজিআইসি) বর্তমান উপদেষ্টা আজিজুল হকও ওই কোম্পানির সাবেক এমডি ছিলেন। রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানির সাবেক এমডি আকতার আহমেদ। মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ডেল্টা লাইফের সাবেক এমডি দাস দেব প্রসাদ। পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সে রয়েছেন সিনিয়র কনসালট্যান্ট (জ্যেষ্ঠ পরামর্শক) রায় দেবদাস, আনিস উদ্দিন মিয়া এবং আবদুল আউয়াল হাওলাদার।
অভিযুক্ত কোম্পানি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের উপদেষ্টা নাসির উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের তথ্য সঠিক নয়। কারণ গ্রীন ডেল্টার উপদেষ্টা হিসেবে আমি আছি। কিন্তু কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করি না। কোম্পানির এমডিই সবকিছু দেখছেন। তিনি বলেন, আমরা কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে মোরতুজা আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমি কোম্পানির পরামর্শক। আর পরামর্শক নিয়োগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন লাগে না। কোম্পানি নিজেই নিয়োগ দিতে পারে। তিনি বলেন, উপদেষ্টা নিয়োগে আইডিআরএর অনুমোদন লাগে। তবে কী কী ক্রাইটেরিয়ায় নিয়োগ দেয়া হবে, সে ব্যাপারে আইনে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপূর্ণ দেশে বীমা খাতের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ খাতে মূল সমস্যা মানুষের আস্থা সংকট। এ সংকটের কারণে এখানে মানুষ পলিসি করতে চায় না। এরপর এটিকে কুক্ষিগত করে রাখলে আস্থার সংকট আরও বাড়বে। তিনি বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়। আর সুশাসন না থাকলে সার্বিকভাবে এ খাতে স্বচ্ছতা আসে না।
২০১০ সালের বীমা আইনের ৮১ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘আপাতত বলবৎ? অন্য কোনো আইনে অথবা বীমাকারীর সংঘবিধিতে যা কিছুই থাক না কেন, কোনো বীমাকারী দুই জনের অধিক উপদেষ্টা নিয়োগ করিবে না এবং উক্তরূপ নিয়োগ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতিরেকে হইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ নিযুক্ত উপদেষ্টার নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারিত থাকিবে এবং তাহাকে প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হইতে হইবে। তবে এই নিয়ম মানছে না কোম্পানিগুলো। উপদেষ্টা বা পরামর্শকরাই মূলত এ খাতের নীতিনির্ধারক।’

আইডিআরএ সূত্র জানায়, দেশের ৭৮টি বীমা কোম্পানির মধ্যে জীবন বীমা ৩০টি এবং সাধারণ বীমা ৪৮টি। দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি। বর্তমানে এ খাতে সম্পদের পরিমাণ ৩৫ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমায় ২৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা এবং সাধারণ বীমায় ৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। তবে প্রতারণার কারণে বিশাল এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। ২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/10/29/167201