২৯ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:০২

আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা

৩০ ব্যাংককে তলব বাংলাদেশ ব্যাংকের

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হঠাৎ করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৫ অক্টোবর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ৮০ টাকা ৮৫ পয়সা দেখানো হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ওই দিনে কিছু ব্যাংক প্রতি ডলার ৮৩ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছে। আবার গত কয়েক দিনেও বাংলাদেশ ব্যাংকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। আগে ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত ডলার বাজারে বিক্রি করতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসত। এখন কিছু ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান করতে না পেরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার হঠাৎ এমন অস্থিশীল হওয়ার কারণ জানতে ৩০ ব্যাংককে তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সাথে আগামীকাল সোমবার এ নিয়ে বৈঠক হবে বলে নিশ্চিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়েনি, এরপরও হঠাৎ করে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার এমন অস্থিতিশীল হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যাংকই আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করত; চাহিদা ছিল তার চেয়ে কম। এ দিকে দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার ব্যাংক নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে না। বাজারেও ডলারের চাহিদা না থাকায় দিন শেষে জরিমানা এড়াতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করত। কিন্তু ডলার কিনে নগদ টাকা ছাড়ায় বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাকিতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা শুরু করে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ডলার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ে ছয় মাস মেয়াদি বন্ড ধরিয়ে দিত ব্যাংকগুলোকে। এভাবে বাকিতে ডলার বিক্রি করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যায়।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক পরামর্শে ব্যাংকগুলো ডলার বিনিয়োগের জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। এক সময় পথও পেয়ে যায়। ব্যাংকগুলো অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ডলার বিনিয়োগ করতে থাকে। একপর্যায়ে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পাঁচ বিদেশী ব্যাংকসহ ৩৬টি ব্যাংক প্রায় ৯০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
এ দিকে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডলার বিনিয়োগ করায় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দেয়। আগে যেখানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ক্রেতা ছিল না, এখন ক্রেতা বেশি বিক্রেতা ব্যাংক কম। এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো এক দিকে অফশোর ব্যাংকিংয়ে ডলার বিনিয়োগ করছে, অপর দিকে ব্যাংকগুলো দেদার পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে (আমদানি ঋণপত্র স্থাপন করেছে)। কিন্তু এলসির দায় পরিশোধ করার জন্য আগাম ডলার সংস্থান করেনি। যখন এলসির দায় পরিশোধ করার সময় এসেছে তখনই দেখা দিচ্ছে বিপত্তি। দায় মেটানোর জন্য আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার কেনার জন্য আসছে। কিন্তু এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন মার্কেট প্লেয়াররা। যাদের হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত তহবিল রয়েছে। এ সুযোগে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। এভাবেই দীর্ঘ দিনের স্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে পাঁচ বিদেশী ব্যাংকের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈঠক করেছে। আগামীকাল ৩১ বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাথে বৈঠক করা হবে। ব্যাংকগুলো তহবিল সংস্থান করে এলসি খুলতে নির্দেশ দেয়া হবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ঋণ আমানতের সীমা পরিপালনের জন্য ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সীমা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করবে, তার ৮৫ ভাগের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না। কিন্তু কিছু ব্যাংকের এ সীমা ছাড়িয়ে ৯৩-৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এতে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এটা এড়াতেই ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হবে।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/263893