২৯ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:৫২

সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ গত ২২ অক্টোবর রবিবার ২৪ ঘন্টার এক ঝটিকা সফরে ঢাকা এসেছিলেন। তার এই সফরের গুরুত্ব কি? কি তাৎপর্য বহন করে তার এই সফর? এসব প্রশ্ন নিয়ে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গত ৩/৪ দিন ধরে তুমুল আলোচনা হলো। অনেকে তো তার এই সফরকে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ‘এ্যাক্ট ইস্ট’ পলিসির সম্প্রসারক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। নানান জনে নানান কথা বলেছেন। তবে আমার কাছে এই সফরের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে মহাকবি সেক্সপিয়রের অমর নাটক ম্যাকবেথের একটি সংলাপের কথা মনে পড়ে গেল। ম্যাকবেথ নাটকের এ্যাক্ট-৫ এর ৫ম দৃশ্যের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ম্যাকবেথ বলছেন, “It is a tale told by an idiot, full of sound and fury signifying nothing.” বাংলা অর্থ হলো, “এটি একটি গল্প যেটি বলেছে একজন বেকুব। এই গল্পে আছে অনেক হৈচৈ। কিন্তু এর ভেতরে কিছুই নাই। অর্থাৎ ভেতরটি সম্পূর্ণ ফাঁকা”। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকায় ঝটিকা সফর খুঁটিনাটি ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমার সেটিই মনে হয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, এই সফরে বাংলাদেশ কোনো কিছুই পায়নি। আর পাওয়ার কিছু কি ছিল? কিছু দেওয়ার জন্য কি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন? আমরা যদি তার সফরের পটভুমি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবো যে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ২২ তারিখ। চলে গেছেন ২৩ অক্টোবর। কিন্তু তার সফরের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল আড়াই মাস আগে, অগাষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। তখনও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন শুরু হয়নি। এই সফরের সাথে লন্ডন থেকে বেগম খালেদা জিয়ার তড়িঘড়ি করে ঢাকা আগমনকেও রিলেট করা যায় না। কারণ যতদূর মনে পড়ে, বেগম জিয়া ৩ মাস আগে লন্ডন যান। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর নির্ধারিত হয় বেগম জিয়া লন্ডন যাওয়ার পর। সুষমা স্বরাজের সফরের প্রধানত দুইটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হলো, বাংলা-ভারত জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিটির চতুর্থ বৈঠকে যোগ দেওয়া। দ্বিতীয় হলো, ঢাকাতে ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে, এমন ১৫ টি প্রকল্প উদ্বোধন করা। এর মধ্যে প্রধান হলো ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন ভবনের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন। এই সবগুলো কাজই তিনি করেছেন। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি ভারতীয় হাই কমিশন কর্তৃক আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন।

অতিরিক্ত যে দুটি কাজ তিনি করেছেন সেগুলি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ। এবং আরেকটি হলো তার হোটেল কক্ষে গিয়ে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ। পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে এগুলো তার রুটিন কাজ। এর আগে প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠকের মধ্যে একটি ওয়ান টু ওয়ান বা একান্ত বৈঠকও হয়েছিল। ২০১৪ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় এসেছিলেন তখনও তার সাথে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম জিয়ার সাথে বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকের ফাঁকেও দুই নেত্রীর মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান বৈঠক হয়। এবার সুষমা স্বরাজ শেখ হাসিনার সাথে একান্ত বৈঠক করেছেন, কিন্তু বেগম জিয়ার সাথে একান্ত বৈঠক করেনি। তবে আমার কাছে সুষমা এবং বেগম জিয়ার মধ্যে একান্ত বৈঠক না হওয়াকে নেতিবাচক অর্থে বিবেচনা করার কোনো কারণ দেখি না।
বরং এই বৈঠকের ব্যাপারে যেটি সকলের চোখে পড়েছে সেটি হলো এই যে, যেহেতু তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী তাই বাংলাদেশের মানুষের মনে এই স্বাভাবিক আশাবাদ ছিল যে তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে হয়তো একটা কিছু হবে। কিন্তু চরম বিস্ময়ের বিষয় হলো এই যে, তিস্তা ইস্যুটি তাদের আলোচনায় স্থানই পেল না। অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০১৫ সালে বলেছেন যে অতি সহসাই আপনারা তিস্তার ব্যাপারে একটি ইতিবাচক খবর পাবেন। এরপর আড়াই বছর পার হয়ে গেছে। ইতিবাচক নেতিবাচক কোন খবরেরই দেখা নাই। আগের মেয়াদে দিপু মনি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি বহুবার তিস্তা নিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন। তিস্তা চুক্তি এই আজ হবে কাল হবে, এমন কথা উনি অনবরত বলেই গেছেন। বলতে বলতে তার মন্ত্রীত্বের ৫ বছর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তিস্তা ইস্যু ভারতীয় হিমাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
আরো অনেক ইস্যু আছে, যেগুলো সুরাহার দাবি রাখে। বাংলাদেশের পণ্য ভারতে গেলে এখনও ট্যারিফ বেরিয়ারের সম্মূখীন হয়। এখনও সীমান্তে হত্যা চলছে। গঙ্গা চুক্তি হয়েছে, কিন্তু চুক্তি মোতাবেক যতখানি পানি পাওয়ার কথা ছিল তার অর্ধেকও নাকি আমরা পাচ্ছি না। অবাক ব্যাপার হলো এই যে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এই সব ইস্যু বাংলাদেশের টেলিভিশন এবং খবরের কাগজগুলোও তুলে ধরেনি। সুতরাং সুষমার এই সফরকে বাংলাদেশের স্বার্থে সফল বলি কিভাবে?
॥দুই॥
সুষমার এই সফরকে কেন্দ্র করে যে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পলিটিশিয়ান এবং মিডিয়া বেশি করে মাথা ঘামাচ্ছে সেটি হলো বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে ভারত বাংলাদেশকে কি বার্তা দিল। এ সম্পর্কে দৈনিক ‘প্রথম আলো’তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় ভারত। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের জন্য ‘সহায়ক পরিবেশ’ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। আর বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেটা ঠিক করবে এ দেশের জনগণ। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই বার্তা দিয়ে গেছেন।

ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনীতি, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশের একটি সরকারি সূত্র জানায়, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সব সময় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে। তাই ভারত যে বাংলাদেশে অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়, সেটি সুষমা স্বরাজ বলেছেন। এ জন্য সব দলকে নিয়ে অংশ গ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের দায়িত্বের কথা বলেছেন। আর নির্বাচনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির সময় সাবধানি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রসঙ্গটিও তিনি উল্লেখ করেছেন বলে জানা যায়। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে আলোচনায় খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনের প্রসঙ্গটি তুলেছেন। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন কম, শুনেছেন বেশি।
॥তিন॥
বিভিন্ন পত্রিকায় এ সম্পর্কে অনেক রিপোর্ট এসেছে। সে সবের সামারি করলে যা দাঁড়ায়, তা নিম্নরূপ: বাংলাদেশে ভারত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এ ব্যাপারে বেগম জিয়া অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলেন। সুষমা স্বরাজ বলেছেন, অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়িত্ব সরকারের। এসব রিপোর্টে বলা হয় যে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে বর্তমানের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে বেগম জিয়া আলোকপাত করেন। এমন কি তিনি প্রধান বিচারপতি সিন্হার বাধ্যতামূলক ছুটি এবং বিদেশ যাওয়ার প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক সুষমা স্বরাজ বেগম জিয়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু উত্তর দেন খুব কম।

বিএনপি নেত্রী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার প্রসঙ্গ তুললে সুষমা রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতির জন্য রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ সব পক্ষকে একসঙ্গে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রসঙ্গটি আলোচনায় তোলেন বিএনপি নেত্রী। এ সময় সুষমা স্বরাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভারতের নির্বাচন পরিচালনার প্রসঙ্গ টানেন। তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করাকে ‘প্রক্রিয়ার বিচ্যুতি’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সুষমা স্বরাজ বলেছেন, বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, সেটি ঠিক করবে এ দেশের জনগণ। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সুষমা স্বরাজের বক্তব্যের এই অংশটি বিরোধী দলের জন্য নেতিবাচক। রাজনৈতিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা উঠলে সুষমা যখন বলেন যে, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ সব পক্ষকে একসঙ্গে দায়িত্ব নিতে হবে তখন তিনি পরোক্ষভাবে শাসক দলকেই সমর্থন করে যান। কারণ রাজনৈতিক পরিবেশ শ্বাসরুদ্ধকর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বন্দুকের জোরে। বাংলাদেশে বিএনপি এবং জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলি গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে। গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আদায় করার জন্য তারা তো আর সশস্ত্র আন্দোলন করতে পারে না, এবং সেটিতে তারা বিশ্বাসীও নয়।

সহায়ক সরকার বা তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পর্কে বিএনপি যে বক্তব্য দিয়েছে সেটিকে বলতে গেলে সুষমা স্বরাজ তথা ভারত নাকচ করে দিয়েছে। সেটি নাকি প্রক্রিয়ার বিচ্যুতি। অথচ এই তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারা বাংলাদেশে সহিংস, অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। তারা এটি করলে হয় গণতান্ত্রিক, আর অন্যেরা বললে হয় প্রক্রিয়ার বিচ্যুতি।
॥চার॥
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে কিভাবে নির্বাচন হবে, সেটি ঠিক করবে এ দেশের জনগণ। তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। প্রশ্ন হলো, কিভাবে নির্বাচন হবে সেটি নাকি ঠিক করবে জনগণ। জনগণ কিভাবে ঠিক করবে? সরকার তো বলছে যে তাদের অনির্বাচিত এবং অবৈধ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। এখন দেশের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন চায় না। কিভাবে তারা সেই দাবি আদায় করবে? শক্তি প্রয়োগ করলে তো বলা হবে সন্ত্রাসী রাজনীতি।

আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হতে হবে, আওয়ামী লীগের এই অবস্থান প্রত্যক্ষভাবে হোক আর পরোক্ষভাবে হোক, সুষমা স্বরাজ তথা ভারত সমর্থন করেছে। অথচ বিরোধী দলের প্রধান দাবি ৩ টি। (১) নির্বাচনের ৩ মাস আগে জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন হতে পারবে না। (২) শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। (৩) সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। দেখা যাচ্ছে এই তিনটি দাবির একটিও আওয়ামী সরকার এবং ভারত সরকার মেনে নেয়নি। অংশগ্রহণমূল নির্বাচন বলতে তারা বোঝায়, আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনার অধীনে সবগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। সেই নির্বাচন করে বিরোধী দলের কি লাভ? আওয়ামী লীগ সরকার তাদেরকে জয়লাভ করতে দেবে না। কারচুপি এবং শক্তি উভয়টি প্রয়োগ করে তারা যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জয়লাভ করবে। তাহলে সেই নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি তথা বিরোধী দলের কোনো ফায়দা নাই। সেজন্যই আমরা শুরুতেই বলেছিলাম যে সুষমা স্বরাজের এই সফরের ফলাফল আসলে শূন্যগর্ভ।

http://www.dailysangram.com/post/305373