২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৬

ভাবমূর্তি সংকটে বিমান

অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনায় বিমান এখন ভাবমূর্তি সংকটে। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এখন কারিগরি যথাযথ তদারকি ছাড়াই আকাশে উড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আকাশে ওড়ার পর বোয়িং উড়োজাহাজে ধরা পড়ছে যান্ত্রিক ত্রুটি। ঘটছে চাকা ফেটে যাওয়া এবং খুলে পড়ার মতো ঘটনা। ফলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটে কমছে যাত্রীর সংখ্যা। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

কিছু পাইলটের দক্ষতায় বহুবার বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন যাত্রীরা। কারিগরি তদারকির অভাবে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে

বহন করা ভিআইপি ফ্লাইটের অয়েল ট্যাঙ্কারের নাট ঢিলা থাকার মতো গুরুতর ঘটনাও ঘটছে। রাষ্ট্রপতিকে বহন করা ভিভিআইপি ফ্লাইটেও ত্রুটি পাওয়া গেছে। যাত্রীবোঝাই উড়োজাহাজের ইঞ্জিন চালু রেখে পাইলটদের ডিউটি ফ্রি শপে কেনাকাটা করতে যাওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটছে। উড়োজাহাজের চাকার অটো লক না খুলে নেওয়া হচ্ছে রানওয়েতে। গ্রাউন্ড সাপোর্টে থাকা মিনি ট্রাকের আঘাতে ভাঙছে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন। এ ধরনের এন্তার অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ বিমানের বিরুদ্ধে।

গত বুধবার উড্ডয়নের পর বিমানের চাকা খুলে ছিটকে পড়ে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশের ধানক্ষেতে। পরে ফ্লাইটটি হযরত

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করাতে বাধ্য হন পাইলট ক্যাপ্টেন আতিকুর রহমান। পাইলটের দক্ষতায় রক্ষা পান যাত্রীরা। উড্ডয়নের আগে সংশ্নিষ্ট প্রকৌশলীর অদক্ষতা ও অসাবধানতার কারণে বিমান বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে বলে মনে করছেন বিমান বিশেষজ্ঞরা। এসব দুর্ঘটনার দায় প্রকৌশল বিভাগের হলেও মজার ব্যাপার প্রকৌশল শাখার প্রকৌশলীরা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত বছরের ২৭ নভেম্বর হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বোয়িং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদ এয়ারপোর্টে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। উড়োজাহাজের ইঞ্জিন অয়েল ট্যাঙ্কের একটি নাট ঢিলা থাকায় ওই বিপত্তি ঘটে। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি মনুষ্যসৃষ্ট বলে প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি।

এর আগে জুন মাসে সৌদি আরব সফর শেষে দেশে ফিরছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে বহনকারী বিমানটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার আগ মুহূর্তে রানওয়েতে ধাতব বস্তুর মতো কিছু একটা দেখতে পান পাইলট। অবতরণ না করে ট্রাফিক কন্ট্রোলে যোগাযোগ করেন তিনি। সেই ধাতব বস্তুটি সরানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা বিমানটি রানওয়েতে অবতরণ করে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ধাতব বস্তুর ওপর বিমান অবতরণ করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত বছর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির ভিভিআইপি ফ্লাইটেও বিপত্তির ঘটনা ঘটে। সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনার আগে নিয়ম ভেঙে রাসায়নিক মেশানো পানি দিয়ে ওই ফ্লাইটের ইঞ্জিনের ব্লেড পরিস্কার করা হচ্ছিল। ফ্লাইটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি বিমান উড্ডয়নের আগেই ধরা পড়ে। ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। তিনি ১১ ডিসেম্বর দেশে ফিরে আসেন।

এর আগে আকাশে ওড়ার মুহূর্তে চাকা ফেটে যায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজের। ফলে ওমানের মাস্কাট থেকে চট্টগ্রামগামী উড়োজাহাজটি ঢাকায় জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। নামতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারায় ফেটে যায় আরও একটি চাকা। তবে ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান বিমানের বিজি-১২২ ফ্লাইটটির ১৪৯ জন যাত্রী ও সাতজন ত্রুক্র। ঝুঁকিপূর্ণ জরুরি অবতরণের আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। পরে প্রায় দুই ঘণ্টা পর বিমান ওঠানামার জন্য রানওয়ে খুলে দেওয়া হয়। এ ঘটনার মাত্র ১০ দিন পর বিমানের একটি উড়োজাহাজ মিয়ানমারের উদ্দেশে যাত্রা করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছার পর সমস্যা ধরা পড়লে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করে।

এর কিছুদিন পরই ঘটে চাকার পিন না খুলে আকাশে উড়ে ফের জরুরি অবতরণের অবাক করা কা। গত জুন মাসে ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইটের পাইলট চাকার পিন ?না খুলেই আকাশে উড়ে পরে জরুরি অবতরণে বাধ্য হন। গত বছরের জুন ও অক্টোবরে গ্রাউন্ড সাপোর্ট শাখার গাড়ির আঘাতে বিমানের দুটি বোয়িং উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ভেঙে যায়। গত বছরের ১১ জুন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ একটি ফ্লাইট জরুরি অবতরণ করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। উড়োজাহাজের চাকা ফেটে যাওয়ায় ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ওই ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করে। এর আগে মাস্কাট থেকে আসা একটি ৭৩৭ উড়োজাহাজেও একই সংকট দেখা দেওয়ায় ক্যাপ্টেন নওশাদ দক্ষতার সঙ্গে রানওয়েতে অবতরণ করেছিলেন।

গত বছরের ২৮ নভেম্বর ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইটেও দুই দফা যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এর আগে ৩ মার্চ শাহজালালের রানওয়ের শেষ প্রান্তের ব্যারিয়ার ভেঙে উড্ডয়ন করে জেদ্দাগামী বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ। তবে অলৌকিকভাবে ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় বিমানটি। ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে ছেড়ে আসা বিমান দুর্ঘটনার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদসহ বহু যাত্রী।

চলতি বছরের ৭ আগস্ট মাস্কাটগামী বিমানের ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করে ভারতের রায়পুর বিমানবন্দরে। অল্পের জন্য রক্ষা পান ১৭৩ জন যাত্রী। বিমানের আরেকটি ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১৩৬ যাত্রী নিয়ে সিঙ্গাপুর যাত্রা করেছিল। বিমানটি রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের পরই বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে পাইলট জরুরি অবতরণ করাতে বাধ্য হন।

২০১৫ সালের ২৮ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় পড়ে বিমানের এ-৩১০ উড়োজাহাজ। ফ্লাইট নম্বর বিজি ০৮৫ সিঙ্গাপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে উড়োজাহাজের দ্বিতীয় ইঞ্জিনে আগুনের সংকেত পান বৈমানিক। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় বিমানের বোয়িং-৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ। একইভাবে ২০১৪ সালের ২৮ মার্চ সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় বিমানের এয়ারবাস এ-৩১০ উড়োজাহাজ।

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী অরুণ চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'প্রকৌশল শাখার অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সঠিকভাবে উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।'

বাংলাদেশ বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ সমকালকে বলেন, 'প্রতিদিন বিশ্বে লাখ লাখ ফ্লাইট পরিচালিত হয়। এর মধ্যে বহু ফ্লাইটের চাকা ফাটে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। উড়ন্ত অবস্থায় বা অন্য যে কোনো কারণে চাকা ফেটে যাওয়া বা বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি হলে তা জরুরিভাবে সারানোর ব্যবস্থা বিমানের রয়েছে। ১৯৮৪ সাল থেকে বিমানের দুর্ঘটনায় একজনেরও প্রাণহানি হয়নি। পাইলট ও প্রকৌশলীদের দক্ষতায় বিমান এসব মোকাবেলা করে আকাশে উড়ছে।'

 

http://www.samakal.com/bangladesh/article/17101708