২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৪

ভাঙাচোরা ডেমরা-বনশ্রী সড়কে ভোগান্তি

বুধবার বেলা সাড়ে ১২টা। ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার মোড়ের সিগন্যালের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ। প্রতি মিনিটেই ওই মোড় দিয়ে বনশ্রী সড়কে ঢুকছে ভারী ওজনের ট্রাক-লরি। ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টের নাকের ডগা দিয়েই ওই সড়কে চলাচল করছে সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে ভারী যানবাহন। অথচ সরু ওই সড়কটিতে ৫ টনের বেশি ভারী যান চলাচলে গত জুনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট। কিন্তু ভারী যান চলাচলের কারণে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের একাধিক স্থানে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ।

কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে কয়েক ফুট গর্ত। এছাড়া সড়কের বেশির ভাগ স্থানে ছোট-বড় অসংখ্য ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। অনেক জায়গায় সড়ক দেবে গিয়ে বড় সুড়ঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে। আর ওই গর্তে পড়ে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে স্কুলগামী কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী-চালকেরও ভোগান্তির শেষ নাই। ডেমরা, বনশ্রী ও রামপুরা এলাকার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা ও ওই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী চালকরা এই সড়কের বেহালদশার জন্য ভারী যান চলাচলকেই দায়ী করেছেন। ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার মোড়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট মহিউদ্দিন বলেন, এই সড়কে হাইকোর্টের একটি রিট ছিল। কিন্তু রিটটি শিথিল করে এখন সব যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। তাই এসব ভারী যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।

গত ৫ই জুন এক আদেশে ঢাকার রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী হয়ে ডেমরার আমুলিয়া পর্যন্ত সড়কে ভারী যানবাহন চলাচলে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই সড়ক দিয়ে ভারী যান চলাচলে বাধা না দেয়ায় এবং সড়কটিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না-এ মর্মে রুল জারি করে আদালত। বনশ্রী এলাকার এক বাসিন্দার করা রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি শেষে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ডিএমপি কমিশনার, রামপুরা, খিলগাঁও থানার ওসিসহ ১১ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয় আদেশে। এলাকাবাসী জানান, ২০১২ সালের ওজন নীতিমালা অমান্য করে ওই সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করায় বনশ্রী-আমুলিয়া সড়কে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে এই সড়কে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। বিশেষ করে রাত ৯টা থেকে শুরু করে সারারাত এই সড়ক দিয়ে ভারী যান চলাচল করায় সড়কের অবস্থা নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যানজটের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

জানা গেছে, হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রামপুরা-ডেমরা-আমুলিয়া সড়কটি মাত্র কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়। ওই রাস্তায় সর্বোচ্চ ৫ টনের যানবাহন চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও তদারকির অভাবে ৪০-৫০ টনের লরি-ট্রেইলরও চলছে। এতে রাস্তাটি নির্মাণের এক বছরের মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী হয়ে রাস্তাটি মিশেছে ডেমরা হাইওয়ের ডেমরা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে । প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে ঢাকা সড়ক বিভাগের ‘এই সড়ক দিয়ে অতিরিক্ত ভারবাহী যানবাহন চলাচল নিষেধ, অনুরোধক্রমে, নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ ঢাকা সড়ক বিভাগ ঢাকা’ লেখা সাইন বোর্ডে রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা সংবলিত সাইন বোর্ড বসানো থাকলেও চালকরা তা আমলে নিচ্ছেন না। এমনকি দিনের বেলায়ও ট্রাফিক পুলিশকে রাস্তায় সঠিক ওজনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ডেমরা-বনশ্রীর একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা জানিয়েছেন, স্টাফ কোয়ার্টার মোড়ে ও রামপুরা ব্রিজের দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশদের পণ্যবাহী চালকেরা টাকা দিয়ে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। এজন্য চোখের সামনে এসব যানবাহন চলাচল করলেও ট্রাফিক পুলিশরা নীরব দর্শক।
ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সন্ধ্যার পর থেকে এই সড়কে ভারী যান চলাচলের কারণে এই সড়কের একপাশ থেকে অন্যপাশে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করলেও তারাও কখনো কখনো এসব যান নিয়ন্ত্রণে অসহায় বোধ করেন। ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার মোড়ের ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন জানান, সকাল থেকেই ভারী পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল শুরু হয়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাতভরই পণ্যবাহী যানবাহন আসা-যাওয়া করে। জাহাঙ্গীর নামের ওপর এক ব্যবসায়ী জানান, যখন হাইকোর্টের রিট কার্যকর ছিল তখনও ভারী যানবাহন চলাচল করেছে। আর এখন রিট শিথিল হওয়ার পর থেকে রাত-দিন সবসময়ই চলে। সরজমিন রামপুরা ব্রিজ থেকে বনশ্রী হয়ে মেরাদিয়া পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, ভারী যান চলাচলের কারণে এই অংশের প্রায় পুরো সড়কেই খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। মেরাদিয়া থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তায় পার হতে হয় আধা ঘণ্টা বা কখনো তার বেশি সময় লাগছে। স্বাধীন বাসের চালক মো. আনারুল মিয়া জানান, রামপুরা থেকে মিরপুর যেতে যে সময় লাগে তার বেশি সময় লাগে মেরাদিয়া থেকে রামপুরা ব্রিজ আসতে। বৃষ্টি হোক আর শুকনা হোক মেরাদিয়া আসলেই আর গাড়ির চাকা ঘুরে না। একই বাসের যাত্রী রিয়াজ উদ্দিন জানান, এই সড়কটি এখন ঢাকা শহরের সবচেয়ে জঘন্যতম। বৃষ্টি হলে আর এই সড়ক দিয়ে চলাচল করার কোনো উপায় থাকে না। তার উপর আবার এই সড়ক দিয়ে ভারী ভারী যানবাহন চলাচল করছেই। বনশ্রীর পদ্মা ফার্নিচার মার্টের মালিক আবুল কালাম আজাদ জানান, কিছুদিন দিনের বেলা ভারী যানবাহন চলাচল করেনি। শুধু রাতের বেলা করতো। কিন্তু ইদানীং সকাল থেকে শুরু করে সারা রাতই বড় বড় ভারী ওজনের পণ্যবাহী যান চলাচল করছে। তার উপর এই সড়কটি মেরামত করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, ভাঙাচোরা এই সড়কে নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী থেকে বিভিন্ন কল-কারখানার ভারী গাড়ী আসার কারণে সড়কের বেহাল দশা। রামপুরা ব্রিজে দায়িত্বরত ট্রাফিকের সার্জেন্ট রাশেদ বলেন, আগে রিট ছিল ভারী যানবাহন চলতে পারবে না, কিন্তু এখন রিট আছে চলতে পারবে। সড়কের এই বেহালদশা আর তীব্র যানজট নিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাস্তাটি মেরামত করা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের মেয়রও অনেকবার এই সড়কটি পরিদর্শন করে গেছেন। তারপরও মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। তিনি বলেন, অতিরিক্ত যানবাহন চলাচলের কারণেই রাস্তার এই অবস্থা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=89373