২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৩

বিআরটিসিতে নয়-ছয়

ভেতরে যাত্রীতে ঠাসা। দরজায় ঝুলছে যাত্রী। রাজধানীতে চলাচলকারী প্রতিটি বিআরটিসি বাসের এ চিত্র। তারপরও বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে। এর কারণ হিসেবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতির নানা চিত্র। ৮৫১টি বাস পরিচালনা করছে বিআরটিসি।
৭৫ সিটের একটি দোতলা বাস থেকে প্রতিদিন নির্ধারিত রাজস্ব পাচ্ছে ৬৩০০ টাকা। সে হিসাবে মাসে ১,৮৯,০০০ টাকা রাজস্ব পাচ্ছে বিআরটিসি। সেখান
থেকে দৈনিক তেলের জন্য ব্যয় ৩৫০৫ টাকা করে মাসে ব্যয় হচ্ছে ১,০৫১৫০ টাকা। চালকের গড়ে ২০,০০০ টাকা বেতনসহ বাদ দিলে মাসে থাকে ৬৩,৮৫০ টাকা। এখান থেকে প্রতি মাসে মেরামত ও অন্যান্য খাতে ২০,০০০ টাকা বাদ দিলেও জমা থাকে ৪৩,৮৫০ টাকা। তারপরও বিআরটিসি লাভের মুখ দেখছে না কেন? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০ বছরেরও অধিক বয়সী বাস চলছে বিভিন্ন রুটে। কিন্তু বিআরটিসির ক্ষেত্রে ভিন্ন। কোম্পানির ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ার আগেই চলাচলের অযোগ্য হচ্ছে বাস। এমনকি মাত্র তিন-চার বছরের মধ্যেই চলাচলের অযোগ্য হচ্ছে বাস। বারবার মেরামত করা হচ্ছে। বিআরটিসির ১১৪৮টি বাসের মধ্যে মেরামত কারখানায় পড়ে আছে ৫৭২টি বাস। এরমধ্যে মেরামতযোগ্য ৩৯০টি। নিয়মিত মেরামতের নামে বিআরটিসির ডিপোগুলোতে হচ্ছে লাগামহীন দুর্নীতি। অভিযোগ রয়েছে ডিপো ম্যানেজারদের বিরুদ্ধে। ম্যানেজার থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে অন্দর মহল। সেটি হচ্ছে টেকনিক্যাল শাখা, যা সম্পর্কে সাধারণের কোনো ধারণা নেই। বিশ্বস্ত নিজেদের লোক দিয়ে পরিচালনা করা হয় শাখাটি। অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ লোক নিয়োগ দিয়ে নির্বিঘ্নে দুর্নীতি করা হচ্ছে। মেরামতের নামে গাড়িপ্রতি লাখ লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
বিআরটিসির মিরপুর-১২ ডিপোতে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে মেরামত করা হচ্ছে অনেক বাস। এরমধ্যে রয়েছে সাতটি অশোক লিল্যান্ড। পাশের অন্য একটি গাড়ি থেকে পার্স খুলে লাগানো হচ্ছিল ঢাকা মেট্টো-ব ১১-৬২৩৬ নম্বর বাসে। যারা মেরামত করছিলেন এ বিষয়ে তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। ২০১৩ সালে ভারত থেকে ২৯০টি বাস আমদানি করা হয়েছিল। চার বছর না পেরুতেই এই বাসগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ২০১০ সালে চায়না থেকে আমদানি করা ২৭৫টি বাসের মধ্যে ৯০টির অবস্থা নাজুক। অথচ ওয়ারেন্টি অনুসারে এসব বাস অন্তত ২০ বছর রুটে চলার কথা।

২০০২ সালে সুইডেন থেকে কেনা হয়েছিল ভলবো বাস। বিশ্বখ্যাত এই ব্র্যান্ডের প্রতিটি বাসের দাম পড়েছিল এক কোটি ৩ লাখ টাকা। বিলাসবহুল এই বাসটি ১৫ বছর পেরুনোর আগেই চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ডিপোতে পড়ে আছে বিকল হয়ে। বিআরটিসি সূত্র জানিয়েছে অর্ধশত বাসের মধ্যে মাত্র একটি ভলবো বাস চলাচল করছে বিআরটিসির বহরে। এই ৪৯টি ভলবো বাস মেরামতের জন্য অন্তত ৩২ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। সূত্রমতে, নিয়মিত মেরামত হয় না বিআরটিসির বাসগুলো। বরং কমদামি টায়ার, কমদামি পার্স ব্যবহার করে বেশি দামের বিল করা হয়। মতিঝিল, মিরপুর, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা ডিপো সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে একটি পিস্টন ব্যবহার করে ছয়টি পিস্টনের বিল আদায় করা হয়। একটি গাড়ির পিস্টন অন্য গাড়িতে ব্যবহার করেও বিল আদায় করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে মেরামত করেই লাখ লাখ টাকার বিল আদায় করে এই চক্র। চার হাজার টাকার প্রকৃত বিল এই চক্রের ভুয়া বিলে পরিণত হয় অর্ধলাখ টাকায়। এরকম নজির রয়েছে অনেক। খোদ বিআরটিসির অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিআরটিসির এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিআরটিসির বাস ডিপোতে ৪১৮৫ টাকার রং লাগানোর ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬৩৫০০ টাকা।
দুর্নীতির সুবিধার্থে মিরপুর-১২ এর বিআরটিসির ডিপোতে টেকনিক্যাল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন ‘আ’ আদ্যক্ষরের এক ব্যক্তি। ছয় মাস আগেও তিনি সাধারণ একজন মেকানিক ছিলেন। সূত্রমতে, ডিপো ম্যানেজারের বিশ্বস্ত হওয়ার কারণেই তাকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। নিয়মিত মেরামতের নামে ভুয়া বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করে চক্রটি। অন্যদিকে বাসের আয়ু কমতে থাকে। এভাবেই একসময় অকেজো হয়ে যায় বিআরটিসির বাস। অথবা মেরামতযোগ্য হলেও তখন বিপুল টাকা মেরামত ব্যয় সংস্থান করা দুষ্কর হয়ে যায় বিআরটিসির। অন্যদিকে, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি বেতন ভাতা বেড়েছে কর্মরতদের। ২০১৫ সালে বেতন ভাতা ছিল মোট ৩ কোটি ৫২১ লাখ, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ১০ লাখ টাকায়। ব্যয় বেড়েছে। দুর্নীতি রোধ হয়নি। এসব কারণেই দিনের পর দিন লাভের মুখ দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিআরটিসি।
এসব বিষয়ে বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ ভূঁইয়া বলেন, সঠিক নিয়মে বাস কেনা হয়নি। তারপর মেরামত ও পার্স ব্যবহারেও অনিয়ম রয়েছে। বিআরটিসি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে এটি অন্যতম সমস্যা। এসব অনিয়মে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=89468