২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:১১

ঢামেক মর্গে জমছে লাশের পর লাশ

রাজধানীতে প্রতিদিনই মিলছে একাধিক অজ্ঞাত লাশ। সেই সঙ্গে রয়েছে নবজাতকের লাশও। অজ্ঞাত লাশের ময়নাতদন্ত হচ্ছে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মর্গে। কিন্তু মাস দেড়েক ধরে দাফনের দায়িত্বে থাকা আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের লাশ গ্রহণে ভাটা পড়েছে। আর ২০ দিন ধরে কোনো লাশই নিচ্ছে না তারা। এর কারণ হিসেবে প্রথমদিকে কবরস্থানের জায়গার সংকটের কথা বলে আসছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

কিন্তু মাসখানেক আগেই মোহাম্মদুপুরের বসিলায় ৭ একর জায়গা তাদের দেয়া হলেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সেখানে এখন বাঁশ, চাটাই আর শ্রমিকের খরচের টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে না এই অজুহাতে তারা লাশ দাফন বন্ধ রেখেছে। ফলে ঢামেক ফরেনসিক মর্গে জমছে লাশের স্তূপ। এর মধ্যে গত একদেড় মাসের লাশও রয়েছে। ছাড়িয়ে গেছে অর্ধশতাধিক। তার প্রায় অর্ধেক নবজাতকের লাশ। অপ্রতুল রেফ্রিজারেটরে কয়েকটি লাশ রাখা হলেও সিংহভাগই ফেলে রাখা হয়েছে মেঝেতে। দাফনের অভাবে তা পচে-গলে যাচ্ছে। উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে মর্গের আশপাশে। গতকাল ঢামেক মর্গে গিয়ে দেখা গেছে, একটি কক্ষে গাদাগাদি ও একটির ওপর অরেকটি লাশ রাখা হয়েছে।

ঢামেক মর্গের সহকারী রামু চন্দ্র দাশ বলেন, অজ্ঞাত পরিচয় লাশ দাফনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সর্বশেষ গত ৭ই সেপ্টেম্বর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম ৭টি অজ্ঞাত পরিচয় লাশ মর্গ থেকে গ্রহণ করেছিল। বার বার ধর্ণা দিলেও তারা আর কোনো লাশ গ্রহণ করতে গাড়ি পাঠায়নি। ফোন করা হলে কবরস্থানে জায়গা সংকটের কথা বলে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের ডিউটি অফিসার মাহমুদুল হাসান বলেন, জুরাইন করবস্থানে আমরা অজ্ঞাত লাশ দাফন করে আসছিলাম। অজ্ঞাত লাশের জন্য বরাদ্দ করা জায়গা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই বিষয়টি উল্লেখ করে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ গত একমাস আগে অজ্ঞাত লাশ দাফন করতে নিষেধ করে দেয়। এরপর গত মাস খানেক আগে মোহাম্মদপুরের বসিলায় কবরস্থানের জন্য ৭ থেকে ৮ একর জায়গা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এখনো ওই কবরস্থানের জন্য বাঁশ, চাটাই ও শ্রমিকের বেতনসহ লাশ দাফনের বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তাই আমরা লাশ নিতে পারছি না। এই তুচ্ছ কারণেই দাফন না হয়ে লাশ নষ্ট হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন টাকা না দিলে হয়তো আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম অচিরেই নিজ অর্থায়নে দাফনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

গলায় ফাঁস দিয়ে আশুলিয়ায় গত সেপ্টেম্বরে আত্মহত্যা করেছিল জহুরা (২৭)। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর ঢামেক মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত হয়। কিন্তু তার অতি দরিদ্র স্বজনরা লাশ দাফনের খরচও জোগাড় করতে পারেনি। তাই আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফনের জন্য লিখিত অনুরোধ জানিয়ে লাশটি রেখে যায়। কিন্তু দু’মাসেও দাফন হয়নি জহুরার লাশটি।
একই কারণে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আটকা পড়ে ৫৩টি লাশ। এর মধ্যে ২৮টি লাশ প্রাপ্ত বয়স্কদের। জহুরা ও কবিরসহ মাত্র দু’জনের নাম পরিচয় জানা গেলেও ২৬টি লাশের পরিচয় এখনো অজ্ঞাত। আর বাকি ২৫টি লাশই নবজাতকের। এদিকে ঢামেক মর্গে চারটি লাশের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ৫টি রেফ্রিজারেটর রয়েছে। তার মধ্যে একটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। বাকি ২টিও কিছুদিন ধরে নষ্ট ছিল। তা মেরামত করা হয়েছে। আর অবশিষ্ট দু’টি রেফ্রিজারেটরে মাত্র ৮টি লাশ রাখা হয়েছে। বাধ্য হয়ে বাকি ৪৫টি লাশই মর্গ ও হাসপাতালের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে বলে জানান মর্গ ও হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

প্রাপ্ত বয়স্ক ২৮টি লাশের মধ্যে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত (৪৫) বছরের অজ্ঞাত এক নারীর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় গত ১লা অক্টোবর। গত ৪ঠা অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানা থেকে আসা (৩৮) বছরের অজ্ঞাত পুরুষ, পরদিন খিলগাঁও ও জিআরপি থানা থেকে আসা (৫৪) ও (৪০) বছরের দুই অজ্ঞাত পুরুষের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ৬ই অক্টোবর পল্লবী, বনানী ও জিআরপি থানা থেকে আসা আরো তিন লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ১২ই অক্টোবর ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত (৬০) বছরের বৃদ্ধ ও পরদিন বিমানবন্দর থানা এলাকায় নিহত আহমদ কবিরের (৪২) লাশের ময়নাতদন্ত হয়। গতকাল পর্যন্ত এভাবে অন্তত ২৮টি লাশ জমা পড়েছে মর্গে।
গত ৬ই সেপ্টেম্বর ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হন রাজধানীর রূপগঞ্জের জহুরুলের স্ত্রী শান্তা। প্রসব করেন সন্তান। ১০ই সেপ্টেম্বর মারা যায় নবজাতক। কিন্তু গত প্রায় তিনমাস ধরে এখনো দাফন হয়নি ওই লাশ। এরপর ২৯শে সেপ্টেম্বর একই হাসপাতালে ভর্তির পর কামরাঙ্গীর চরের মামুনের স্ত্রী রুমানা সন্তান প্রসব করেন। এরপরই মারা যায় সেই নবজাতক। এখনো দাফন হয়নি লাশ। আর চলতি মাসের বিভিন্ন দিনে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করা রুমা, রুমানা, রিনা, সুজানা, শেফালী-১, শেফালী-২, শেফালী-৩, সালমা, জায়দা, আসমা-১, আসমা-২, নুরজাহান, ফাতেমা-১ ফাতেমা-২, শাপলা, খাদিজা-১, খাদিজা-২, শাহনাজ, মাজেদা, নিলুফা, আকলিমা, হেলেনা ও ঝর্ণার প্রসব করা নবজাতকরা এখনো কবরস্থ হয়নি। তাদের অধিকাংশের বাড়িই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়।

ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডা. প্রদীপ বিশ্বাস মানবজমিনকে বলেন, আসলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই পরিস্থিতির শুরু হয়েছিল গত কোরবানির আগে বিভিন্ন এলাকা ডুবে যাওয়ার পর থেকে। তখন জুরাইন কবরস্থানে জায়গার সংকটের কথা বলে লাশ নেয়া কমিয়ে দেয় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। আর এই মাসের শুরু থেকেই আঞ্জুমান লাশ নেয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে যেখানে কয়েকদিন পরই লাশ নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে এতদিনে লাশগুলো পচে গলে নাজুক অবস্থা। মর্গের কাছে থাকা এনাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীরাও দুর্গন্ধে টিকতে পারছে না। আমরা সমস্যা সমাধানে আঞ্জুমান ও দুই সিটি করপোরেশনের কাছে ধর্ণা দিলেও কোনো সুরাহা মিলেনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=89464