৭৭ কিমি. জুড়ে শুধু খানাখন্দ আর গর্তঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ৭৭ কিমি. এলাকায় পিচ উঠে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। ছবিটি শুক্রবার গৌরনদীর ভুরঘাটা থেকে তোলা
২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:০৩

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক

৭৭ কিমি. জুড়ে শুধু খানাখন্দ আর গর্ত

চরম দুর্ভোগে যাত্রীসাধারণ

জাতীয় মহাসড়কের খাতায় নাম থাকলেও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ৭৭ কিলোমিটারের (ভুরঘাটা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত) অবস্থা বেহাল। চলাচলের অনুপযোগী। এই পুরোটা পথই খানাখন্দ আর গর্তে ভরা। এ কারণে দক্ষিণের ছয় জেলার যাত্রী সাধারণকে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। কেবল এই অঞ্চলের বাসিন্দারাই নন, পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা এবং দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রায় নানা প্রয়োজনে যারা আসেন তাদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রতি বছরই সড়ক সংস্কার করা হয়। আবার বর্ষা এলে সেই আগের অবস্থায় ফিরে যায়। সড়কটি এখন দক্ষিণের মানুষের জন্য স্থায়ী দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীসহ সমুদ্রবন্দর পায়রা এবং পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় সড়কপথে পৌঁছতে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক ধরেই যেতে হয়। বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৭৭ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই পথের মধ্যে একটানা ভালো আছে এমন দুই কিলোমিটারও নেই। তার ওপর গত প্রায় দুই বছর ধরে চলছে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ। ফলে আরও কঠিন হয়ে পড়েছে সড়কের পরিস্থিতি। গত মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সড়কপথে বরিশালে আসেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। এই পথে এসে তাকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সড়ক পথেই তার ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অসংখ্য গর্ত আর খানাখন্দে ভরা সড়কে ঝাঁকুনি সয়ে তিনি আর ওই পথে যেতে রাজি হননি। তাই বরিশালের জেলা প্রশাসককে ফোন করে নৌপথে তার ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করতে বলেন। পরে লঞ্চেই তার ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ৭৭ কিলোমিটারের এই দুরবস্থা নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর শুকনো মৌসুমে মহাসড়কটির সংস্কার করা যেমন একটি নিয়মিত কাজ তেমনি প্রতি বছরই বর্ষায় তা আবার ভেঙেও যায়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের একটি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মহাসড়কটির এই অংশের মেইন্টেন্যান্সে ব্যয় হয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। কিন্তু ফলাফল শূন্য। বর্ষা এলেই ধুয়ে যায় সব। সড়ক ফিরে যায় তার পুরনো চেহারায়। বর্তমানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, চলাচলেরই অনুপযোগী হয়ে পড়েছে সড়কটি। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত ৩৪ কিলোমিটার জায়গা রয়েছে যেখানে গর্ত আর খানাখন্দ ছাড়া কিছুই নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই এসব জায়গা তলিয়ে যায় পানির নিচে। তখন কোনটা মহাসড়ক আর কোনটা খাল নালা বোঝা মুশকিল।

বরিশাল বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি আফতাব হোসেন বলেন, ‘সড়কের দুরবস্থার কারণে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনাকবলিত হচ্ছে যানবাহন। ভুরঘাটা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক পেরুতে সময় লাগছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে বাসের যন্ত্রাংশও ভাঙছে প্রতিদিন। পরিস্থিতি এমন যে, মহাসড়কের ওই অংশে বাস চালাতে চাইছেন না চালকরা। মহাসড়কের সংস্কার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন এবং মানববন্ধন বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে।’

বারবার সংস্কারের পরও কেন এই অবস্থা- জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মূলত সমস্যা হিসেবে তিনটি বিষয় কাজ করছে। এগুলো হল- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে নিন্মমানের ঠিকাদারি কাজ, প্রভাবশালীদের মদদপুষ্ট ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কেবল সংস্কার।’ ওই প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘ঠিকাদার হিসেবে যারা কাজ করছেন তাদের দুর্নীতি যেমন আছে, তেমনই সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই মহাসড়কটির আয়ু শেষ হয়ে যাওয়া। বহু বছর আগে যখন এই মহাসড়কটি নির্মাণ হয় তখন প্রকৌশলপদ্ধতি আজকের মতো এতটা উন্নত ছিল না। পরে এটি নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটা করা হয়নি। কেবল ভাঙাচোরা সড়কে সংস্কারের নামে চালানো হয়েছে মেরামত। বেইজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রতিবারই সেই সংস্কার ধুয়ে যায় বর্ষায়। বর্তমানে সড়কের প্রশস্তকরণসহ যে মেরামতের কাজ চলছে তার ভবিষ্যৎও একই হবে। কাজ শেষ হওয়ার বছরখানেকের মাথায় আবারও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে।’

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বরিশাল সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আধুনিক প্রকৌশলগত নির্মাণকাজ এই মহাসড়কে হয়নি সেটা যেমন ঠিক, তেমনি বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে সড়কটির সংস্কার করতে চাচ্ছি সেটা যে মোটামুটি টিকসই হবে সেটাও ঠিক। বর্তমানে মহাসড়কের প্রশস্তকরণ এবং সংস্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা। এর আওতায় মহাসড়কে ৫০ মিলিমিটার ওভার লে করার কথা ছিল। আমরা হিসাব করে দেখেছি, এই পরিমাণ ওভার লে করা হলে আসছে বর্ষায় তা আবার ধুয়ে যাবে। তাই প্রকল্পটি সংশোধন করে আরও ১৬ কোটি টাকা যোগ করার একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। নতুন এই প্রস্তাবের আওতায় মহাসড়কে ৭০ মিলিমিটার ওভার লে এবং ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো মেরামতের পর পুনরায় ৫০ মিলিমিটার ওভার লে করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটা করা হলে আশা করি আগামী ৪-৫ বছরে সড়কটিতে কোনো সমস্যা থাকবে না।’

যেখানে মহাসড়কের বেইজই ভালো নয়, সেখানে এভাবে কাজ করলে চলাচলের স্বাভাবিকতা কতদিন বজায় থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক চারলেন করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমরা আশা করছি, খুব শিগগিরই সেই কাজ শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে পুরো সড়কটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ হবে। এ অবস্থায় ওই কাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত মহাসড়কটি যাতে চলাচলের উপযোগী থাকে সেই চেষ্টা করছি আমরা। এ কারণেই বাড়তি কোনো ব্যয় এই মুহূর্তে করা হচ্ছে না।’

সড়ক ও জনপথ বিভাগ বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যেই সড়ক সংস্কারেরকাজ শেষ হবে। যদিও এই কাজ শেষ করার জন্য আগামী বছরের জুন মাস পর্যন্ত সময় দেয়া আছে। আশা করি এরপর আর যানবাহন চলাচলে কোনো সমস্যা থাকবে না।’

https://www.jugantor.com/last-page/2017/10/28/166924