২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৮:৫১

রোহিঙ্গা সঙ্কট : সমাধান ভাবনা

‘রোহিঙ্গা সঙ্কট’ দিন দিন জটিল রূপ নিচ্ছে। প্রথম দিকে যেভাবে বিষয়টা দেখা হচ্ছিল, সেরকম সহজ নয়। ব্যাপারটার সমাধান খুব একটা সহজ নয় তা বিগত এক মাসে খানিকটা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
বলা হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যাবে। এটা যারা বলছেন, তারা হয়তো না বুঝেই বলছেন, নয়তো নিজের ঘাড়ে দায় নিতে চাচ্ছেন না। দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেছেন আমাদের দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় নেতারা। বলেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনও।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের বিপক্ষে এবং মিয়ানমারের পক্ষে রয়েছেÑ এমন ভাবার কারণ নেই। তিনি আরো বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় জোরালোভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে অচিরেই কয়েকটি দেশে বিশেষ দূত পাঠানো হবে। মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে।’
কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিয়ানমার ক্রমাগত সেসব চাপ উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা নিধন অভিযান অব্যাহত রেখেছে। পালিয়ে আসা, আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। বাড়ছে মানবিক বিপর্যয়ের দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ঘটনা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সামাল দিতে না পারায় পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না এ দেশে। তারা খোলা আকাশের নিচে নো ম্যান্স ল্যান্ডে রোদ-বৃষ্টি সয়ে অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য। আরো হাজার হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন প্রদেশে অপেক্ষমাণ সীমান্ত অতিক্রমের জন্য।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে নয়; কিন্তু এটা কিভাবে প্রমাণ হবে? গত মাসের শেষের দিকে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল চাপ এবং বিশ্ব জনমত উপেক্ষা করেই মিয়ানমারের পক্ষেই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে চীন ও রাশিয়া। কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েও ভেটো ক্ষমতার অধিকারী প্রভাবশালী ওই দুই দেশকে কি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে সম্মত করানো গেল? ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) এতদিন অত্যন্ত দৃঢ় মনোভাবে ভূমিকা রাখতে দেখেছি, মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান মিন অংসহ সশস্ত্রবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানানো স্থগিত ঘোষণাসহ ইত্যাদি ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে, তারাও সুর পাল্টাচ্ছেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে? ধীরে ধীরে মিয়ানমারের ওপর চাপ আলগা হতে চলেছে। জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্বনেতাদের সরব হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার নাটক করার জন্য ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার’ প্রস্তাব দিয়ে অং সান সু চির দফতরের মন্ত্রী কিউ টিন্ট সোয়েকে পাঠানো হলো। ব্যস ওই পর্যন্তই।
হতাশার সুর শোনা গেল বাংলাদেশে ইইউ নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রেঞ্জে তেয়াবিঙ্কের কণ্ঠে। তিনি খোলামেলাভাবে বলে ফেললেন, চীন ও রাশিয়ার কারণেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ প্রতিবেশী ভারতের ওপর আমরা এত ভরসা রেখেছিলাম, তারাও হতাশ করেছে। কিছু দিন আগে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন বললেন, ‘ভারতের তেমন কিছু করণীয় নেই। মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।’ তিনি চীনকে বরং কাজে লাগাতে বললেন। এমনকি ভারতের পক্ষে মধ্যস্থতা করাও নাকি সম্ভব নয়।
এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভাবছেন বিশেষ দূত পাঠিয়ে ওইসব দেশকে বাংলাদেশের পক্ষে আনবেন। এটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
কার কী অস্ত্র আছে এবং সেই অস্ত্রের ধার কতটুকু, তা প্রকাশ্যে প্রদর্শন এবং পরখ করে দেখানো হয় এখন। কখনো যুদ্ধ বাধিয়েও পরীক্ষা করা হয়। কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশফেরাও চলে বেশ প্রকাশ্যে বলে কয়ে। তাই বুঝতে বাকি থাকে না, কোন দেশ কার সাথে গাঁটছড়া বাঁধা এবং কোন দেশ কার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের জ্ঞানগম্যি, বিদ্যাবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা স্বল্প নয় মনে হয়। বিশ্বের এসব পরিবর্তনের পালাকে তারা বুঝতে পারেন অবশ্য। তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন রোহিঙ্গা সঙ্কটি ‘মিয়ানমারের’। তাই সমাধান করতে হবে মিয়ানমারকে। ‘ভিকটিম বাংলাদেশ’সহ তার সমাধান করবে দু’দেশ মিলেÑ এমন সরলীকরণ করে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখনো নিরূপিত হয়নি। আগের কতজন ছিল তার প্রকৃত তথ্য জানা নেই। বলা হচ্ছে পাঁচ লক্ষাধিক আশ্রয়প্রার্থী প্রবেশ করেছে। তা-ও রেজিস্ট্রেশন না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না সঠিক। সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। এতে কার কী স্বার্থ রক্ষা হয় তা আরেক প্রসঙ্গ।
এমনকি ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট’ নিয়ে লিখতে গিয়ে ইতিহাস-ভূগোলের অবতারণা ছাড়াও আন্দাজ করা যায় কোনো কোনো লেখক গবেষণার ধার ধারেন না। এতে মূল বিষয় হারিয়ে যায়।
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এদের পরিচয় নিয়ে। রেজিস্ট্রেশনে এদের ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে ‘মিয়ানমার থেকে প্রত্যাগত’। একইভাবে মিয়ানমার সরকারও এদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং রোহিঙ্গা হিসেবেও স্বীকার করে না। তাহলে ওরা কোন পরিচয় নিয়ে বাঁচবে?
আজকের মিয়ানমারের প্রদেশের নাম রাখাইন স্টেট (১৪টির মধ্যে একটি), পূর্বে আরাকান রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলিমদের খাম্ভইক্যা, জেরবাদী, কামানচি ও রোহিঙ্গা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি ছিল। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গাদের পরিচয়ে বাকিরা নিজের পরিচয় বিধৃত করতে স্বস্তিবোধ করে। বর্তমানে ওরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও রোহিঙ্গা পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ পরিচয় তাদের জন্য নিয়ে আসে একরাশ সহানুভূতি ও সহায়তা।
রোহিঙ্গারা বার্মা সরকার (১৯৪৮ এ ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর) শুধু মুসলিম হওয়ার অপরাধে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। সরকারের বাহিনী এবং উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নির্যাতনে টিকতে না পেরে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিতাড়িত হয়েছে। আজকে তা ধরা পড়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। ২০১৭-তে এসে নিধনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাচ্ছে বার্মা প্রশাসন।

রোহিঙ্গাদের বসবাস পাঁচ লাখ সৌদি আরবে, পাকিস্তানে দুই লাখ ৫০ হাজার, থাইল্যান্ডে এক লাখ, গালফ স্টেটগুলোতে ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়ায় ৪০ হাজার ৭০, ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজার ৯৪১, ভারতে ৪০ হাজার, নেপালে ২০০, বাংলাদেশে আনুমানিক ৯ লক্ষাধিক।
গত বছর অক্টোবরে যে অভিযান পরিচালনা করে মিয়ানমার সরকার, তাতে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা চীনেও আশ্রয় নিয়েছিল বলে জাতিসঙ্ঘের অভিবাসীসংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। এবার অবশ্য চীন কিংবা ভারতে আশ্রয় গ্রহণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কারণ সীমান্তে কড়া পাহারা রেখেছিল দু’টি দেশই। ভারত ঘোষণা দিয়েই বলেছিলÑ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না। এমনকি আগের ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করতে চেয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সুয়োমোটো আদেশে আটকে যায় সেই প্রক্রিয়া। এবার আগস্টের শেষের দিকে ‘আরসা দমনের নামে’ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু এবং অনন্যোপায় হয়ে তারা বাংলাদেশের টেকনাফ, উখিয়া ইত্যাদি এলাকায় প্রবেশ করতে চায়। তখন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড বাধা দেয়। এমনকি রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার ফেরত যেতে গুলি চালানো হয়। এতে বহু রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে বাধ্য হয়। তবে এরা অনেকেই মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের হাতে নিহত হয়। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এই ‘পুশব্যাক নীতি’ অবলম্বন না করা হলে, হতাহতের সংখ্যা কমতে পারত। রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থীদের তত্ত্বাবধান ও ত্রাণ পরিচালনার দায়িত্ব প্রথম থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেয়া গেলে ওদের কষ্টের লাঘব আরো ১৫ দিন আগেই হতে পারত।

বলা যায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদকে টেলিফোনে জানালেন, রোহিঙ্গাদের প্রবেশে বাংলাদেশ যাতে বাধা না দেয় এবং তাদের আশ্রয়-আহারের ব্যয় বহন করবে তুরস্ক সরকার। সেই সাথে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক নেতা, মানবতাকর্মীরা একযোগে আহ্বান জানালেন রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে দেয়া হোক, এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ও আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সাড়া দেয়।

এরদোগান বিভিন্ন মুসলিম দেশের সরকারপ্রধান, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকেও ফোন করলেন। সাথে সাথে স্ত্রী ফার্স্টলেডি এমিনো এরদোগান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাভাসোগলুককে পাঠালেন বাংলাদেশে। দিলেন জরুরী ভিত্তিতে এক হাজার টন ত্রাণসামগ্রী। এরদোগান কাজাখস্তানের রাজধানীতে ওআইসির প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্মেলনে যোগ দেয়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। তিনি আশ্বস্ত করেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটে তুরস্ক বাংলাদেশের সাথে আছে।
এরদোগান মুসলিম দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে অনুরোধ জানান। তিনি জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সঙ্কট তুলে ধরে জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। শুধু তাই নয়, এরদোগান নিজ উদ্যোগে ওআইসিভুক্ত সব সরকারপ্রধানকে নিয়ে সদর দফতর ভবনে জাতিসঙ্ঘের রোহিঙ্গা প্রশ্নে ওআইসির কনফারেন্স ডাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেন।
রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের যদি সদিচ্ছা থাকে, ভূ-রাজনীতির পথেই হাঁটতে হবে আমাদের। যে দু’টি বিশ্বশক্তির কথা বলা হচ্ছে, তাদের কাছে পেতে যেতে হবে তাদের কাছাকাছি। ভুটান যদি পারে চীন-ভারতের মতো বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের মাঝে নিজেদের নিরাপদ করতে, আমরা কেন পারব না? আর সেটা পারতে হলে মুসলিম দেশগুলোকে কাছে টানতে হবে। ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান ও সৌদি আরব যদি নিজেদের প্রয়োজনে মেরু পরিবর্তন করে রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারে; প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান চীনের ওয়ান বেল্টের বন্ধনে নতুন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পারে আমরা কেন পারছি না? স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ তো দেখতেই হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে সামনে আরো বিপদ আসতে পারে।
বলা হচ্ছে, আসামে ৩০ লাখ বাঙালি শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের বের করে দিতে হবে। তবে রাজ্যসরকার দিল্লির চাপের মুখে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ ব্যাপারে আমাদের এখনই তৎপর হতে হবে। বিপদে যারা পাশে দাঁড়াবে, এমন বন্ধু খুঁজে নিতে হবে এ মুহূর্তেই।হ
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/263496