২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৮:৩৭

মজলুমের দু’আ যদি কবুল হয়ে যায়!

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বিনতে আদেল নামের এক বোনের ফেসবুক টাইমলাইনে জনাব এ কে আজাদ বাশার তার পোস্টে কিছু প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন ঠিক এভাবে:
* ‘যে দেশের রাজধানীতে পতিতারা পুলিশের সামনে রাস্তায় দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে খদ্দের খোঁজে, কিন্তু গ্রেফতার হয় না। গ্রেফতার হন পবিত্র কুরআনের মজলিশ থেকে পর্দানশীন মা-বোনেরা। সে দেশে গজব আসবে না তো, কী আসবে?
* যে দেশে চোর-ডাকাতকে এখন আর রিমান্ডে নেবার কথা শোনা যায় না, রিমান্ড হয় বয়োবৃদ্ধ কুরআনপ্রেমিক সৎ মানুষদের। সে দেশে গজব আসবে না তো, কী আসবে?
* যে দেশে জুয়ার আড্ডা ও অশ্লীল নাচ-গানের মজলিশে ১৪৪ ধারা জারি হয় না, জারি হয় কুরআনের মাহফিলে। সে দেশে গজব আসবে না তো, কী আসবে?
* যে দেশে ফাঁসির আসামি খালাস পায়, আর মায়ের কোলের দুধের শিশু জেলখানার কয়েদী হয়। সে দেশে গজব আসবে না তো, কী আসবে?'
এরপর তিনি আল্লাহর দরবারে দু’আ করেছেন এভাবে :
‘হে আরশের মালিক, আমরা আর সইতে পারছি না। আমাদের ধৈর্যশক্তি বাড়িয়ে দাও। আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী বন্ধু পাঠাও। মূসা আলাইহিসালামকে ফেরাউনের কবল থেকে সদলবলে তুমিই মুক্তি দিয়েছ, সে ক্ষমতা তোমার এখনও আছে। নব্য ফেরাউনদের কবল থেকে আমরা তোমার কাছেই মুক্তি চাই। মুক্তি দাও, হে রব ! মুক্তি দাও!’
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এ পোস্টের জন্য লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ। এর সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতাকেও। পোস্টটির লেখক অনেক অভিযোগ করেছেন। অনেক অভিমান ব্যক্ত হয়েছে এতে। অনেকের কাছে এ পোস্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হতে পারে। কেউ পক্ষপাতমূলকও বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে বিচার-বিবেচনা করলে দেখা যাবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এর বাইরে নয় আদৌ। ক্ষমতাসীনদের বর্তমান কর্মকা-, প্রতিহিংসামূলক একচক্ষু দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’ এই মহাজন প্রবাদবাক্যের শব্দান্তর ঘটে গেছে। অর্থাৎ এখন সেটা হয়েছে এমন, ‘শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন।’ হ্যাঁ, এখন দেশজুড়ে সত্যই যেন দুষ্টলোকদেরই প্রতিপালন চলছে। অন্যদিকে যারা সৎ, ন্যায়পরায়ণ, শান্তিপ্রিয় তাদেরই ঘাড় মটকে দেয়া হচ্ছে।

পুলিশের একশ্রেণির সদস্যের কথাই ধরা যাক। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত। জনগণের করের টাকায় এ বাহিনীর বেতন দেয়া হয়। জনগণের জান-মালের হেফাজতের প্রধান দায়িত্বই এ বাহিনীর। আইনের প্রয়োগ করে থাকে এই পুলিশ। পুলিশবাহিনী এ কাজ করেও। কিন্তু মাঝেমধ্যে পুলিশের কোনও কোনও সদস্য এমন কর্মকা- করে বসেন যেগুলো জনগণের বিরুদ্ধে চলে যায়। আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থি বলে বিবেচিত হয়। অপরাধী গ্রেফতার করতে গিয়ে অবৈধ অর্থ দাবি করা হয়। অপরাধী গ্রেফতার না করে নিরপরাধ মানুষকে পাকড়াও করা হয়। অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে গ্রেফতারকৃতের চোখ উপড়ে নেয়া, এমনকি মেরে ফেলবার অভিযোগও পাওয়া যায়। এমন লোমহর্ষক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বেশি বেশি আজকাল। কিন্তু কেন? এমনতো ঘটবার কথা নয়।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কথাই ধরুন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পার্লামেন্টে দাঁডিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, তিনি রাজাকার ছিলেন না। যুদ্ধাপরাধ তার দ্বারা সংঘটিত হয়নি। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি কোনও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তবু সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী জোগাড় করে তাকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লাকেও কাদের কসাই সাজিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। অথচ এ মোল্লাজী ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজাকার-আলবদরের মতো কোনও বাহিনীতে ছিলেন না। কিন্তু তাকেও ফাঁসানো হয়েছে। শুধু কি তাই? সাকা চৌধুরী তখন পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছিলেন। যুদ্ধের সময় তিনি এদেশেই ছিলেন না এমন সার্টিফিকেটও দাখিল করা হয় কোর্টে। কিন্তু এসব কিছু গ্রাহ্যই হয়নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ফেঁসে গেছেন তিনিও। না এসব রায় নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই। রায়ে যা হয়েছে তাতো মানতেই হবে।

আসলে রাজনৈতিক কারণে এদেশে অনেক কিছুই ঘটে। ন্যায়বিচারের ধার ধারে না কেউ। আর কেউ ধারলেও তার কোনও মূল্য দেয়া হয় না। বিচারকার্য নিয়ে কিছু বলা বা লেখা কিন্তু আমার মতো সাধারণের জন্য বিপজ্জনকই। তবে পাওয়ারফুলদের তেমন কিছু হয় না। দেখলেনইতো ক্ষমতাসীনরা সংসদ এবং এর বাইরেও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বাবুকে কীভাবে নাজেহাল করলেন। তুলোধুনো করে ছাড়লেন। তাই বলি, পাওয়ারফুলরা সবই পারেন। তাদের কিছু হয় না। ভয় কেবল আমাদের। ত্রস্ত থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে। তাই আমি ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি আগেভাগেই। আমি স্যালুট করি আইন-আদালতকে সবসময়। যাদের ফাঁসানো হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধেই ছিল এমন নয়। ক্ষমতাসীন দলেরও কারুর কারুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। কই তাদেরতো কিছু হয় না? বরং তারা ক্ষমতার ভাগও ভোগ করছেন দিব্যি। যতো দোষ কেবল নন্দঘোষদের।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা রাতে ঘুমোতেও পারছেন না। এই বুঝি তাদের গদি উল্টে গেল। ভাবটা এমন। এ না হলে নেতৃবৃন্দকে পুলিশ কেন গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেবে? জেলে আটক করবে? শীর্ষ নেতাদেরতো ফাঁসি হয়েই গেছে। যারা বন্দি তাদেরও ফাঁসানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। ক্ষমতাসীনদের তবু ভয় যেন কাটছেই না। অস্বস্তি পিছু তাড়া করছে নিরন্তর।
একটা কথা সবার মনে রাখা উচিত, সেটা হচ্ছে নিরপরাধ নেতা-কর্মীদের রিমান্ডে নিয়ে কিংবা জেলে পুরে আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে বলে মনে হয় না। এমনকি এখন যারা মাঠে আছেন তাদের সবাইকে গ্রেফতার করলেও আন্দোলন নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ এ দেশের জনগণের সঙ্গে যাদের নিবিড় সম্পর্ক, পরিসর ছোট হলেও দেশবাসী ইতোমধ্যে তাদের চিনে ফেলেছেন। ভালোও বেসেছেন। তাই এদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন যতো বাড়বে, জনসমর্থনও ততো বৃদ্ধি পাবে। আর ঘটছেও তাই।
প্রশ্ন হচ্ছে, যারা বাইরে আছেন তারা সভা-সমাবেশ করতে পারবেন না কেন? আদালত কি কারুর সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে? নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হলেও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয় না বলেইতো আমরা জানি।
একদিকে গণতন্ত্রের ফাঁকা বুলি আওড়াবেন, অন্যদিকে কাউকে সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করতেই দেবেন না, তা কী করে হয়? এসব করে সাময়িক বাধা সৃষ্টি হয়তো করা যাবে, কিন্তু চিরদিন আটকে রাখা যাবে না। ছাইচাপা আগুন জ্বলে উঠলে তা সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে যেতে পারে। ইতিহাসে এমনই ঘটে।
হ্যাঁ, কেউ যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাববিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকলে তার শাস্তি হতেই পারে। কিন্তু বিনা প্রমাণে অথবা নামকা ওয়াস্তে সাক্ষী-সাবুত জোগাড় করে কাউকে ফাঁসালে দুনিয়ার আদালতে ফায়দা হতে পারে। কিন্তু পরকালের আদালতে ছাড় পাবার উপায় নেই। তখন ধরা খেতেই হবে।

উল্লেখ্য, বিএনপি’র ইলিয়াস সাহেব, চৌধুরী আলমসহ অনেক নেতা-কর্মী নিখোঁজ বছরের পর বছর ধরে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছেলে আর্মির সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের অফিসার, মীর কাশেম আলী সাহেবের ব্যারিস্টার ছেলের মতো আরও অনেককে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার পোশাকে তুলে নেবার পর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই পরিবারগুলোর সদস্যরা কেঁদে কেঁদে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলেছেন। এদের বদ দু’আ কি আল্লাহর দরবারে কবুল হবার মতো নয়? এরা কী অপরাধ করেছেন? দেশের কুটিল ও জটিল রাজনীতির মারপ্যাঁচেওতো বেচারাদের তেমন বিচরণ ছিল না। কেন হারিয়ে গেলেন তারা? এই নিখোঁজদের খুঁজে বের করা কার দায়িত্ব? বিএনপি’র একজন নেতা ভারতের আসামে জিনের মতো উড়ে গেলেন। কিন্তু এখনও ফিরে আসতে পারলেন না। কী হয়েছিল তার? তিনি কি দেশে আসতে পারবেন কখনও?

কেউ অপরাধ করলে তার আইনানুগ শাস্তি হবে। এজন্য আদালত আছে। বিচারক আছেন। ন্যায়বিচারে কারুর শাস্তি হতেই পারে। এ ব্যাপারে কারুর তেমন করবার কিছু থাকে না। নিম্ন আদালতের রায় কেউ মানতে না পারলে উচ্চতর আদালতে আপিলেরও সুযোগ দেয়া হয়। এ হচ্ছে আইনের বিধান বা নিয়ম। কিন্তু সমস্যা হয় এর ব্যত্যয় ঘটলে। আমাদের দেশে রাস্তা থেকে সাক্ষী হাইজ্যাক করে নিয়ে দেশের বাইরে পাঠাবার ঘটনাও ঘটেছে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে- এমনটাইতো স্বাভাবিক।

প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর ৯ মাসে ১০৭ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। এদের মধ্যে এমনও আছেন যে, অনেককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বলা হয় ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে। এই যে অপমৃত্যু, এর জন্য কে দায়ী? এই মৃতদের স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা কেউ না কেউতো আছেন। তারা দুনিয়ার আদালতে ন্যায়বিচার না পেলেও আল্লাহ্র দরবারে কাঁদতে তো পারবেন। নাকি তাও মানা? এদের কারুর চোখের পানি আর হৃদয়ের আর্তি যদি রাব্বুল আলামিনের দরবারে কোনওভাবে কবুল হয়ে যায় তাহলে রক্ষা পাবেন কীসে? মজলুমের বদ দু’আ কবুল হওয়াইতো স্বাভাবিক।

http://www.dailysangram.com/post/305236