২৭ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৮

শেয়ারবাজারে যেন জাদুর প্রভাব

জেমিনির ৬শ’ টাকার শেয়ার একদিনেই দুই হাজার

শেয়ারবাজারে যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়া লেগেছে। নজিরবিহীনভাবে একদিনেই একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ২৩৪ শতাংশ। জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠান জেমিনি সিফুডের শেয়ারের দাম বুধবার ছিল ৬০০ টাকা। বৃহস্পতিবার এক লাফে তা ২০০০ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে, যা অস্বাভাবিক বলেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ এই শেয়ারের অভিহিত মূল্য মাত্র ১০ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, হঠাৎ এ ধরনের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে বড় ধরনের কারসাজি রয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ৩২ কোটি টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে, যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মোট লেনদেনের প্রায় ৫ শতাংশ। এত উচ্চমূল্যে কারা এসব শেয়ার কিনেছে সে বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এভাবে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়াতে মালিক পক্ষের যোগসাজশ থাকতে পারে। কারণ বুধবারই কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১২৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। কিন্তু স্পর্শকাতর এই তথ্য আগেই বাজারে প্রকাশ হয়ে যায়। ফলে অত্যন্ত ছোট মূলধনের এ প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক দিন পর্যন্ত লেনদেনের শীর্ষ তালিকায় উঠে আসে। এদিকে হঠাৎ করে কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন দুই কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ এবং সংস্কারের জন্য ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। মূল্য সংবেদনশীল এসব তথ্য আগাম প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তা বিনিয়োগকারীদের ওপর বড় প্রভাব ফেলে। শুধু তাই নয়, গত বছরও ৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছিল জেমিনি সিফুড। এরপর কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিন লাখ ১২ হাজার শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বিপুল অংকের টাকা নিয়ে যায়।
জানতে চাইলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমাদের সার্ভিল্যান্স টিম পর্যবেক্ষণ করছে। অস্বাভাবিক কিছু পেলে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া। তাদের বিলম্বিত পদক্ষেপের আগেই বিপুল অংকের অর্থ বাজার থেকে
বেরিয়ে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিনিয়োগকারীরা।

জানা গেছে, জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) কাজী শাহেদ আহমেদ। চেয়ারম্যান তার স্ত্রী আমিনা আহমেদ, পরিচালক তার ছেলে কাজী নাবিল আহমেদ ও কাজী ইনাম আহমেদ। এ ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে রয়েছেন খোন্দকার হাবিবুজ্জামান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে কারা জড়িত, তা বিএসইসিকে খতিয়ে দেখতে হবে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে তা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বিএসইসির। এর সঙ্গে কারা জড়িত, কেন এই শেয়ারের দাম বাড়ল তা তদন্ত করে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ঘোষণার জন্য বুধবার ঢাকায় বৈঠকে বসে জেমিনি সিফুডের পরিচালনা পর্ষদ। এ সময় আকস্মিকভাবে অনুমোদিত মূলধন দুই কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়। একই সঙ্গে ২০১৬ সালের জন্য ১২৫ শতাংশ বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে। এ সময় জানানো হয়, বিএমআরই’র (ব্যালেসিং, আধুনিকায়ন, প্রতিস্থাপন এবং সম্প্রসারণ) ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। কোম্পানির মেশিন এবং অন্যান্য উপকরণ আধুনিকায়ন করা হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) আগের বছরের চেয়ে কমেছে। ২০১৭ সালে কোম্পানির ইপিএস ১৩ টাকা ৫ পয়সা। আগের বছর যা ছিল ১৩ টাকা ৮১ পয়সা। তবে আগের বছরের প্রতি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদমূল্য ২১ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বেড়ে ২৬ টাকা ৩ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। এদিকে লভ্যাংশ ঘোষণার পর প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সর্বোচ্চ কোনো সীমা ছিল না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে একটি চক্র। ফলে বৃহস্পতিবার এর প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে। এদিন প্রতিষ্ঠানটির তিন লাখ ২৩ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যার মোট বাজারমূল্য ছিল ৩২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এদিন প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্য ছিল দুই হাজার টাকা। তবে সর্বশেষ মূল্য ছিল ৯৯৯ টাকা। গত বছরের ১৭ আগস্ট ৭০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে এই কোম্পানি। এর মধ্যে রয়েছে ২০ শতাংশ নগদ এবং ৫০ শতাশ বোনাস শেয়ার। এরপর শেয়ার বিক্রি শুরু করেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী শাহেদ আহমেদ। পাঁচ দফায় তিনি দুই লাখ ৬২ হাজার ৫০০ শেয়ার বিক্রি করেন। এ ছাড়া কোম্পানির চেয়ারম্যান আমিনা আহমেদ তিন দফায় এক লাখ পাঁচ হাজার শেয়ার বিক্রি করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বোনাস শেয়ার ঘোষণার পরপরই এভাবে শেয়ার বিক্রি অনৈতিক।

জানতে চাইলে জেমিনি সিফুডের কোম্পানি সেক্রেটারি এএফএম নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, সিফুড শিল্পের মধ্যে আমাদের কোম্পানি সবচেয়ে আগে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে এ খাত খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বিদেশি ক্রেতারা কোম্পানির বিএমআরই এবং যন্ত্রাংশ আধুনিকায়নের শর্ত দিয়েছে। যার ফলে বোনাস ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ ওই টাকা দিয়ে কোম্পানির আধুনিকায়নে কাজ করা হবে। আগের বছর এমডি ও চেয়ারম্যানের শেয়ার বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ার বিক্রি করতে তাদের আইনগত কোনো বাধা নেই। এর বাইরে এ প্রসঙ্গে আমার কিছু বলার নেই। কোম্পানির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা বিস্তারিত বলতে পারবেন। জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এ প্রতিষ্ঠানটি। খাদ্য ও সমজাতীয় এ খাতের এ কোম্পানিটি চিংড়ি রফতানি করে। কিন্তু গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে ওঠানামা করেছে। এ সময় উদ্যোক্তারাও ব্যাপক শেয়ার বিক্রি করেছেন। ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের মোট শেয়ারের ৭৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল উদ্যোক্তাদের কাছে। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা কমে ৩৯ দশমিক ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। শেয়ারবাজারে কোম্পানির নিজস্ব পোর্টফোলিও মেইনটেন করছে লংকা বাংলা সিকিউরিটিজ। পরিশোধিত মূলধনের দিক থেকে অত্যন্ত ছোট প্রতিষ্ঠান এটি। বর্তমানে এই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ কারণে গুটি কয়েক বড় বিনিয়োগকারী ইচ্ছে করলেই কারসাজির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিতে পারে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/10/27/166767