২৭ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:২৯

সোনারগাঁওয়ের কালাদরগা থেকে আন্ধারকোঠা

সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরী নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে ইদানীং। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় বিধ্বস্ত বিশ-পঁচিশখানা দালান। এর অধিকাংশই বসবাস অনুপযোগী। যদিও দু’একটিতে কয়েকটি পরিবারের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়। একসময় হয়তো এ নগরীর জৌলুস ছিল। মূলত এ নগরটি ছিল হিন্দু বণিকশ্রেণীর আবাসিক এলাকা। বয়সের দিক থেকে তেমন কোনো পুরানো নয়। দালানগুলোতে যে সময়ফলক উৎকীর্ণ আছে তাতে ধারণাটি অতীতের তেমন কোনো গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তেরশ বিশ বা চব্বিশ বঙ্গাব্দ দূর অতীতের কোনো কাল নয়। সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যে পানামের যে কোনো গুরুত্ব নেই তা কিন্তু নয়। আছে তবে যে কারণে সোনারগাঁও ইতিহাস খ্যাত এমন কি জগৎ খ্যাত এর কিন্তু উল্লেখ পত্রপত্রিকা বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দৃষ্টি গ্রাহ্য হয় না। যতটা পানাম নগরী নিয়ে মাতামাতি। এখানেই গড়ে তোলা হয়েছে কারুশিল্প জাদুঘর, নানান স্থাপনা, বিদেশী আর্থিক সহায়তায় নতুন রূপে সাজানো হয়েছে বড় সর্দারবাড়ি। এক কথায় এলাকাটি দৃষ্টিনন্দন। দর্শনের জন্য প্রবেশ মূল্য প্রয়োজন হয়। পানাম নগরীতেও প্রবেশ পথে বসানো হয়েছে চৌকি। ইতিহাস সংরক্ষণের এই যে আয়োজন তা সত্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে প্রশ্ন এসেই যায় সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস কি পানাম নগরীতেই সীমাবদ্ধ? দর্শনার্থীদের জানানোর ব্যবস্থা নাই, একসময় সোনারগাঁও ছিল সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহর রাজধানী। পরবর্তী সময় বারভুঁইয়া প্রধান ঈসাখাঁর রাজধানী। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিখ্যাত পন্ডিত হযরত শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার জগৎখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছিল বিখ্যাত তাঁতশিল্প মসলিন। সোনারগাঁওয়ে ছিল টাকশাল। সুলতান গিয়াস উদ্দিন তার নামে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন এখান থেকে। টাকশাল স্থাপন করেছিলেন এই এলাকাতেই ঈসাখাঁও। রাজপুরুষগণ বসবাস করতেন এ ভূভাগেই। একসময় নহবত বাজতো। হাতি-ঘোড়ার যাতায়াত ছিল বিস্তর। সেই আলোঝলমল ইতিহাস এখন বিলুপ্ত প্রায়। অবহেলা অনাদরে। এখনো যে সব স্মৃতিচিহ্ন টুকটাক দাঁড়িয়ে আছে সে সব রক্ষণাবেক্ষণেরও কোন ব্যবস্থা নাই। উৎসাহও দেখা যায় না কারো মধ্যে। পানাম নিয়ে অগ্রহ থাকলেও সোনারগাঁওয়ের মূল ইতিহাসের ব্যাপারে তাদের অনাগ্রহটা যেন প্রকট।

প্রকটের এই ফটকেই যেন আটকে আছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন অযমশাহর যত কীর্তি, ঈসা খাঁর যত বীরত্ব, পন্ডিত আবু তাওয়ামার যত শিক্ষানুরাগ, কাজীউলকুজ্জাত কাজী সিরাজউদিদনের যত সত্যনিষ্ঠ ন্যায়ানুগ বিচারপদ্ধতি। সোনারগাঁওয়ের মুগড়াপাড়া এবং এর আশপাশ অঞ্চল জুড়েই ছিল সেই সব ব্যক্তিবর্গের উত্থান পতনের দৃশ্যাবলি। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এমনটাই মনে করেন। যৎসামান্য যা অনুসন্ধান হয়েছে তাতে সে রকমটাই উঠে এসেছে।

আকাশটা মেঘলা ছিল সেদিন, অর্থাৎ গত সাত অক্টোবর ২০১৭। এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেলো ভোরে। সন্দেহের দোলাচলে পড়েছিলাম, যাওয়া যাবে কি যাবে না। সোনারগাঁও ভ্রমণের দিনক্ষণ ধার্য করা ছিল, সঙ্গী অনুজ কবি রেদওয়ানুল হক। দুজনেরই চিন্তার বলিরেখা পড়েছিল কপালে। আল্লাহ সহায় আকাশ তেমনটা গোলমাল করেনি। উভয়েরই বসবাস মিরপুর। আমার সাংবাদিক আবাসিক এলাকা, কালশী আর রেদওয়ানুল হক, রূপনগর, পল্লবীতে। দশটা নাগাদ মিলিত হলাম পুরবী বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বাসে গুলিস্তান। কপাল মন্দ বিজয়সরণির কাছাকাছি এসে আটকা পড়ল বাস। অপেক্ষার রজনী নাকি শেষ হয় না। আমাদের অবস্থাও দাঁড়ালো প্রায় সে রকমেরই। বাস দাঁড়িয়ে থাকলো ঠায়, প্রায় ঘণ্টাখানেক। কারণ বিদেশ ফেরত প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা। সামনে লোকেলোকারণ্য। মিছিল ফেস্টোন ট্রাকে ট্রাকে হচ্ছে গানবাজনা। যুবক বৃদ্ধ মহিলা পুরুষ সব একাকার। প্রচন্ড গরমে বাসে বসে ভাবছিলাম এই ভোগান্তির অবসান কবে। রাজপুরুষদের সুমতিই বা হবে কখন। সেই বিখ্যাত প্রবাদটিই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ‘বাঘে মহিষ লড়াই করে নলখাগড়া প্রাণে মরে।’ নলখাগড়া নামের জনগণ কি পিষ্টই হবে আজীবন। একসময় বাস চলতে শুরু করল। গুলিস্তান যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন প্রায় পৌনে বার। বোরাক পরিবহনের তাপানুকূল বাসটি দাঁড়িয়েই ছিল। কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে ত্বরিৎ বাসে চেপে বসলাম। বাসটি মোটামুটি ছিমছাম। ভাড়াও সাধ্যের মধ্যে। সিট পূর্ণ হতেই চলতে শুরু করল সোনারগাঁওয়ের উদ্দেশে। তাই বোরাক পরিবহনকে ধন্যবাদ। তারা নিয়ম-শৃঙ্খলাকে মান্য করে। অন্য পরিবহনে অনিয়ম বিশৃংখলাই যেন শিরধার্য। আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মুগড়াপাড়া চৌরাস্তায়। শুক্রবার হবার কারণেই হয়তো এই সময় স্বল্পতা। যানবাহনের চাপ ছিল না। সেখানে অপেক্ষায় ছিল দৈনিক সংগ্রামের সোনারগাঁও প্রতিনিধি ইকবাল মজুমদার তৌহিদ, এক হাস্যোজ্জল তরুণ। স্মরণযোগ্য তৌহিদ স্থানীয় প্রেস ক্লাবেরও একজন কর্মকর্তা। এখন থেকে তৌহিদই আমাদের রাহবার।

অতিঅল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম কারুশিল্প জাদুঘর এবং পানাম অঞ্চলে। নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে বড় সর্দার বাড়ি। বেশ দৃষ্টিনন্দন। কোরিয়ার অর্থানুকূল্যে এ সাজ-সজ্জা। সোনারগাঁওয়ে প্রথম এসেছিলাম গত ঊনিশশ চুয়াত্তরে পিকনিকে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। তখনো জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত হয়নি। কেবল মাসটার্সে নৈশ বিভাগ খুলেছিল। তখন বড় সর্দারবাড়ি ভাঙাচূড়া একটি দালান। ভিতরটাও ছিল অপরিষ্কার, প্রায় বিধ্বস্ত। পেছনের কক্ষের এক কোণায় একটি গোপন সিঁড়ি ছিল। নিচের দিকে প্রায় অন্ধকার। এখানে নাকি অবাধ্য প্রজাদের শাস্তি দেয়া হতো। এমনটাই বলতো লোকজন। বাড়ির পেছন দিকটা ছিল আগাছায় পূর্ণ অপরিচ্ছন্ন। বলতে গেলে পুরো এলাকাটাই ছিল অসজ্জিত, অনেকটা অবহেলার শিকার। এখানে অনেকেই বনভোজনে আসতো। মনে আছে বড় সর্দারবাড়ির পেছনে আমাদের বনভোজনের আয়োজন হয়েছিল। রান্নাবান্নার ফাঁকে আমরা কয়বন্ধু মিলে মুগড়াপাড়ায় গিয়াসউদ্দিন আযমশাহর কবর দেখতে গিয়ে ছিলাম। তখনি দেখেছিলাম কবরের ডানদিকের অংশটি ভেঙে একদিকে হেলে পড়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে অযতেœ কবরটির এই দশা। মাথার কাছে একটি চেরাগদানি ছিল। যেখানে স্থানীয় লোকজন প্রতি সন্ধ্যায় বাতি জ্বালাত। সেখানকার একবৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জবাবে সে জানিয়েছিল এক কামেল দরবেশের নাকি এ মাযার। সেখানকার অনেকেরই এমন ধারণা। তখনকার ভাঙা কবরের ছবি ড. মোহাম্মদ মোহর আলীর হিষ্ট্রি অব বেঙলের ২য় খ-ে ছাপা রয়েছে। তখন কবরের পাথরগুলো ছিল অনেকটা ধোঁয়াটে। পাথরের উপরের দিককার কারুকাজ ছিল সূক্ষ্ম এবং চমৎকার। সম্প্রতি সংস্কারকৃত কবরের কাজ তেমনটা নয়। পাথরও অনেকটা কালো রঙের। হয়তো এই কারণেই স্থানীয় লোকজন কবরটির নাম রেখেছে কালাদরগা। পানাম নগর দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে গেল। খাবার আয়োজন করে রেখেছিল তৌহিদ তাদের বাড়িতে। তার অনুরোধে ঢাকা থাকতেই এই দাওয়াত কবুল করেছিলাম। পানাম নগরীর পাশেই তাদের বসবাস। বেশ ছিমছাম এলাকা। কবির ভাষায় বললে বলতে হয় ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’। ষোলপাড়ার সেই শান্তিনীড়েই সুস্বাদু খাবারে রসনা তৃপ্ত করলাম আমরা। এর আগে অবশ্য জোহর আদায় করেছিলাম বাড়ি লাগোয়া নবনির্মিত একটি মসজিদে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল দ্রুত। তাই অপেক্ষা না করে মুগড়াপাড়ার দিকে রওনা দিলাম।

গিয়াসউদ্দিন আযম শাহর কবরে যখন পৌঁছলাম তখন পাশের মসজিদে আযান হচ্ছিল আসরের। মসজিদের পেছনে পাঁচ পীরের দরগা। আমরা সে দরগা দেখতে গেলাম। নাম পরিচয়হীন পাঁচ পীরের কবর পাশাপাশি স্থাপিত। শত শত বছর থেকে টিকে আছে কবরগুলো। এককালে নাকি এর ধার ঘেঁষেই বইতো নদী ব্রহ্মপুত্র। ঐতিহাসিক এই নিদর্শনগুলোকে তেমন পাত্তা দেয় বলে মনে হচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাঁচ পীরের দরগার কোথাও কোনো সম্ভাব্য সময়কাল বা পরিচিতির উল্লেখ পাওয়া গেল না। অবস্থা দেখে মনে হলো না বিশেষ কোনো দৃষ্টি রয়েছে এখানে। অনতি দূরেই শুয়ে রয়েছেন বাঙ্গালার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ। তার ঔদার্যের কাহিনী বই পুস্তকে বহুল আলোচিত। তার রাজত্বকালে বাঘে ছাগে এক ঘাটে পানি পান করতো মধ্য যুগের কবিগণ এমন বাক্য রচনা করেছেন। কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার ইউসুফ জুলিখা’ কাব্যগ্রন্থে এক জায়গায় লিখেছেন- ‘রাজরাজস্বর মৈদ্ধে ধার্মিক পন্ডিত/ দেব অবতার নির্প জগত বিদিত/ মানুষ্যের মৈদ্ধে জেহ্ন ধর্ম অবতার / মহানরপতি গ্যাছ পিরথিম্বীর সার’ এই অতি উদারতা তার কাল হয়েছিল। তিনি রাজাগনেশের ষড়যন্ত্রে পান্ডুয়ায় নিহত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সুলতান গিয়াসউদ্দিন প্রতিবেশী সমাজের অনেককেই তার প্রশাসনে উচ্চপদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমন সিদ্ধান্তই তার দুর্ভাগ্যের রজনী ত্বরান্বিত করেছিল।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন প্রাণীত ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি। তিনি নিজেও আরবী-ফার্সীতে কাব্য সাধনা করতেন। ইরানের কবি হাফিজকে দাওয়াত করেছিলেন সোনারগাঁও ভ্রমণের। বয়সজনিত কারণে কবি ভ্রমণে অপারগতা প্রকাশ করে সুলতানকে একটি কবিতা পাঠিয়ে ছিলেন। দেওয়ানে হাফিজে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। সুলতান গিয়াসউদ্দিন মক্কার উম্মেহানী গেইটে এবং মদীনার শান্তি গেইটে দু’টি মাদরাসা নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সেখানে দু’টি মুসাফিরখানাও স্থাপন করেছিলেন। যাদের ব্যয়ভার বাংলা থেকেই পাঠানো হতো। এ তথ্যটি কাজী কুতুবুদ্দিন হানফীর তারিখে মক্কা গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য চর্চারও তিনি ছিলেন প্রধান পৃষ্ঠপোষক। শাহে বাঙ্গালাহ নামে নিজকে ঘোষণা করেছিলেন। তখনকার স্বাধীন বাংলার সীমানা ছিল অনেক বিস্তৃত। সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসের অনেক পুরানো পৃষ্ঠাই মনের আকাশে উড়ছিল। অবশ্য এ কবরটি নিয়েও অনেক ঐতিহাসিক সন্দেহ পোষণ করেন। হাবীবা খাতুন মনে করেন এটি গিয়াসউদ্দিনের পিতা সুলতান সিকান্দর শাহর হতে পারে। কারণ সুলতান গিয়াসউদ্দিন ১৪১১ সালে নিহত হয়েছিলেন পান্ডুয়ায়। তাই তার কবর সে এলাকায় থাকায়ই যুক্তিযুক্ত। তবে পান্ডুয়াতে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের কবরের কোনো খবর পাওয়া যায়নি আজ অবধি। উল্লেখ্য, সুলতান গিয়াসউদ্দিন বহু বছর সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করে রাজ্য শাসন করেছেন। সুলতান সিকান্দর শাহ ইন্তিকাল করেছেন সোনারগাঁওয়ে। এ কবরটি যদি সুলতান গিয়াসউদ্দিনের হয় তাহলে সুলতান সিকান্দর শাহর কবর সোনারগাঁওয়ে কোথায়? ব্যাপারটি বেশ জটিল। এ জটিলতার জট খুলতে পারেন গবেষকগণ।

কবর চৌহদ্দিতে ঢুকতেই একটি বকুল গাছ, দু’একটি ফুল ঝুলে আছে। দেখে বেশ ভালো লাগলো। এলাকাটি সুনসান, আরো কয়েকটি ফুলগাছ আছে সেখানে। নাই কেবল খাদেম জাতীয় কোনো জনমানুষ। যার কাছ থেকে নানান জিজ্ঞাসার জবাব পাবে দর্শনার্থীগণ। ঢুকতেই একটি শ্বেতপাথর, যাতে উৎকীর্ণ আছে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। কিন্তু যতœ-আত্তির অভাবে লেখাগুলো অনেকটাই অস্পষ্ট। বেশ কষ্ট করেই পাঠোদ্ধার করতে হয়। এতে বুঝা যাচ্ছে কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনো সুনজর নেই এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির প্রতি। একই চৌহদ্দিতে আরো একটি কবর। কর্তৃপক্ষের অনুমান এ কবরটি সুলতান গিয়াসুদ্দিনের প্রধান বিচারপতি কাজী সিরাজউদ্দিনের হয়তোবা। এমনটাই লেখা আছে কবরের কাছে। কবরটির তেমন কোনো জৌলুস নাই। অতি সাধারণ। যদিও দাবি রাখে সম্মান তাজিমের। সময় যাচ্ছিল দ্রুত। সন্ধ্যা নামছে ধীরে। এরি ফাঁকে আসর আদায় করলাম আমরা তিনজন পাশের মসজিদে। ইতিহাসের আরো অনেক হিরকখ- ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুগড়াপাড়ার মাটিতে। তাই সেগুলো দেখার অভিলাষে সুলতানকে পেছনে ফেলতেই হলো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন শুয়ে আছেন ভাগলপুরে। বলাবাহুল্য ভাগলপুর অঞ্চলটি মুগড়াপাড়ারই অংশ বিশেষ। আমরা রিকশায় চড়লাম শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা যে অঞ্চলটিতে শিক্ষার আলো জ্বেলে ছিলেন সে দিকে। বলতে গেলে দ্রুত পৌঁছে গেলাম। আন্ধারকোঠা নামক প্রায় বিধ্বস্ত এক ক্ষুদ্র দালানের কাছে। বিশ ফুট বাই দশ ফিটের মতো একটি কক্ষ। দেয়ালের চারধার জুড়েই রয়েছে তাক। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কক্ষটি ছিল শিক্ষক কমনরুম হয়তো। তাকগুলোতে থাকতো মূল্যবান বই-পুস্তক। নিচের দিকে আরো একটি কক্ষ, কিন্তু সেখানে জমে আছে বৃষ্টির পানি। আগাছায় আকীর্ণ দালানটি। অনুমান হয় এটি দ্বিতল কোনো দালান অযতœ অবহেলায় এর এমন দশা। আফসোসের ব্যাপার হলো দর্শনার্থীদের জন্য কোনো দিক নির্দেশনা নাই, প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তরফ থেকে। এই স্মৃতিচিহ্নটি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারেও তারা উদাসিন। মনে হয় এর আশপাশেই ছিল শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, সমরবিদ্যা এবং কোরআন ও ফেকা শাস্ত্র পড়ানো হতো। বহু দূর দেশ থেকে আসতো শিক্ষানুরাগীগণ। তার সে বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নাই মুগড়াপাড়ায়। প্রতœবিভাগ বা গবেষকরাও শীতল। বিষয়টি উদঘাটনে। তারা যতটা তৎপর বৌদ্ধবিহার বা এ জাতীয় কোনো কিছু আবিষ্কারে। ইতিহাস সন্ধানে আপত্তি নাই কিন্তু একচোখা নীতি পরিহার করাতেই মঙ্গল। লজ্জার বিষয় হলো, যেটি ছিল আলোর প্রকোষ্ঠ তার নাম আমরা রেখেছি ‘আন্ধারকোঠা’।

শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা ছিলেন বোখারার লোক। খোরাশানে তিনি লেখাপড়া করেন। সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন ১২৮২ সালের দিকে। রাজকার্য এবং ব্যবসা বাণিজ্যেও তার সংশ্লিষ্টতা ছিল ব্যাপক। আসাম এবং আরাকানে তিনি মুসলিম বসতি স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষক হিসাবেও ছিলেন সর্বজন গ্রাহ্য এক ব্যক্তিত্ব। তিনি সোনারগাঁওয়েই ইন্তিকাল করেন ১৩০০ সালে। শায়খ আবু তাওয়ামার অনুগামী হয়েছিলেন আরো অনেক বুজুর্গ-পাণ্ডিত্যে সোনাগাঁওয়ে মুগড়াপাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পীর-ফকিরের কবরগুলো এমন সত্যকেই প্রকাশ করে।

আন্ধারকোঠার অল্প দূরত্বেই আরো কিছু স্মৃতিচিহ্ন। সেগুলো দেখতে গেলাম। দেখলাম একটি ভাঙা ফটক দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষি হয়ে। বুকের হাড়গুড় বেড়িয়ে আছে। ইটের ফাঁকফোকড়ে গজিয়ে আছে নানা ধরনের আগাছা। নিকটেই বসা ছিলেন খাদেম পরিচয়ে একজন। এখানে নহবত বাজতো। এমন আরো সাতটি ফটক ছিল। জানালেন তিনি। বলাবাহুল্য, এটি তথ্যসমৃদ্ধ নয়। মূলত ফটক একটিই ছিল ব্রাডলে বার্ড তার ‘রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ পুস্তকে এ ফটকটির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনিও ফটকটির বিধ্বস্ত দশাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯০৬ সালে। প্রায় সোয়াশ বছর পর আমরাও একটি জীর্ণ দশায় দন্ডায়মান ফটক দেখলাম। এত দীর্ঘ সময়েও কোনো আত্মীয়ের দেখা পায়নি ফটকটি। তাই অবহেলা অযতেœ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। একটি কবরগাহ আছে সেখানে। পাশাপাশি ছয়টি কবর, পঞ্চম কবরটি সবুজ রঙের। কথিত খাদেম জানালেন এটিই নাকি শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামার কবর। হতেও পারে, যদিও এর কোনো পরিচিতির উল্লেখ নাই। আরো কয়েকটি কবর দেখলাম পাশেই। এ জায়গাতে যে ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তিরা শুয়ে আছেন তা হয়তো বলাইবাহুল্য। এ সব ইতিহাস কেবল আমরা বা আমাদের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের রথী-মহারথীদের অজানা বা জানার আগ্রহ নাই। তাই তাদের চোখে শুধু পানাম নামটিই বড় হয়ে ধরা দেয়। মুগড়াপাড়ার দমদমা নামক স্থানটিতেই নাকি সুলতানদের রাজপ্রাসাদ আরো অন্যান্য স্থাপনা ছিল। বেশীর ভাগ ঐতিহাসিকের ধারণা এটি একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গের অস্তিত্ব নাকি ছিল দমদমায়। ব্রাডলি বার্ট এমন তথ্যই দিয়েছেন তার পুস্তকে। সুলতান এবং রাজ-রাজরাদের আনন্দ উল্লাসে মুখরিত ছিল যে মুগড়াপাড়া এলাকা, এখন কান পাতলেই সে মাটি থেকে উঠে আসে ক্রন্দনধ্বনি। তাদের সম্মান সমভ্রমকে ধরে রাখার বুঝি কেউ নেই।

মুগড়াপাড়ায় ইতিহাসের এত সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এসব জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য একটি লিফলেট জাতীয় পুস্তক প্রকাশ করা দরকার। যেখানে থাকবে সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। স্থাপনাগুলোর অবস্থান। দর্শনার্থীদের জন্য নির্দেশিকা রূপে এটি কাজ করবে। প্রতœতত্ত্ব বিভাগ বা পর্যটন বিভাগ থেকে এটির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে প্রবেশ মূল্য ধার্য করলেও মন্দ হয় না। এতে এ প্রজন্মের ইতিহাস জানার প্রতি যেমন আগ্রহ বাড়বে, কর্তৃপক্ষের পকেটে কিছুটা হলেও অর্থ আসবে। কারুশিল্প জাদুঘরের পুস্তক বিপণী কেন্দ্র থেকে এমন নির্দেশিকা সরবরাহ করলে অসুবিধাটা কোথায়? দিনমান ঘুরাফেরাতে ক্লান্তি এসে ভর করছিল শরীরে, মনে। পায়ে পায়ে আসছিল অন্ধকার। তাই ইতি টানতে হলো আজকের ভ্রমণের। সোনারগাঁওয়ের ইতিহাসকে অন্ধকারে ফেলে পরবর্তী গন্তব্যে রওয়ানা দিলাম আমরা তিনজন।

http://www.dailysangram.com/post/305125