২৬ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৮

রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ধেয়ে আসছেবিবিধ প্রসঙ্গ

মাসুদ মজুমদার



সরকার এক দিকে নির্বাচনের আমেজ সৃষ্টি করতে চায়; অন্য দিকে রাজনীতির তর্কিত ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি করতে চায় না। আবার বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যুক্তিহীন হয়রানিমূলক তৎপরতাগুলো অব্যাহত রেখেছে। ইসির সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ সরকারকে কী বার্তা দিয়েছে, সেটা স্পষ্ট। সরকার সে ব্যাপারেও ঝেড়ে কাশতে চায় না। ভাবখানা এমন, সালিস মানি তালগাছ আমার। বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়ে বিতর্কটা জিইয়ে রেখে সরকার কিভাবে লাভবান হতে চায়, সেটাও স্পষ্ট নয়। বিচার বিভাগ বারবার বিব্রত হলে শুধু রাষ্ট্রের নয়, সরকারেরও ক্ষতি। রোহিঙ্গা ইস্যুকে সরকার এখনো সিরিয়াস ইস্যুর তালিকায় রেখেছেÑ এমনটি মনে হয় না। এর সাথে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির মেলবন্ধনটা যেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুঝতেই পারছে না। সম্ভবত এ কারণেই সরকারপ্রধানও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। যা বললে জনগণ খুশি হবে তাই বলার চেষ্টা করে বাহবা নিতে চাচ্ছেন। এত গভীর একটি সঙ্কট এতটা অগভীরভাবে ভাবার দায়টা বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
দুর্নীতি, আইনের শাসনের অভাব, দলতন্ত্রের দলবাজির নানা কিসিমের উপসর্গ হঠাৎ মিলিয়ে যাবে কিভাবে! অতীতের পাহাড়তুল্য ভুলগুলো তো এখনই গ্রাস করতে উদ্যত হবে। পুলিশি শাসন আর কত! অর্থনীতির রুগ্ণ শরীর একেবারে উদোমÑ এটা কাউকে দেখাতে হচ্ছে না।

বিশ্বরাজনীতির মাঠে যারা দাবড়ে বেড়ান তারা কে কী করছেনÑ সে ব্যাপারেও আমাদের সরকারের কোনো হোমওয়ার্ক নেই। সরকার ভাবছে বিএনপিকে সাইড লাইনে ফেলে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। বাস্তবে খেলাটাকে এতটা সরলীকরণের মধ্যেই রাজনৈতিক আত্মহত্যার কারণ লুকিয়ে নেইÑ তার নিশ্চয়তা কে দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসঙ্ঘ সাথে থাকার মধ্যে কূটনৈতিক সাফল্য খোঁজার চেয়ে অন্য গন্ধ খোঁজার দায়টা ছোট নয়। এমন অনেক শক্তি সরকারের পৃষ্ঠপোষকÑ যারা কারণ ছাড়া থুথুও ফেলে না। আবার তাদের মতো একটা পক্ষ বন্ধু হলে তার আর শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না। এর সাথে তারেক জিয়াকে খুঁচিয়ে বেড়ানোর মাজেজা কী বোধগম্য নয়। জামায়াতকে নিয়ে নতুন টানাহেঁচড়া কার স্বার্থ রক্ষা করবে। যখন দেশে শত্রু কমিয়ে বন্ধু বাড়িয়ে জাতীয় ঐক্যের ভিতটা মজবুত করার মাধ্যমে সরকারের বার্গেনিং ক্ষমতা বাড়ানোর গরজ বেশি, তখন সরকারের দীর্ঘ হায়াত দারাজের জন্য দোয়াভিক্ষার মধ্যে এক ধরনের হেঁয়ালি আছে, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নেই।
বিরোধী দলগুলোর হোমওয়ার্ক সম্পর্কে ধারণা করা যায়, বাস্তবে পরিমাপ করা অসম্ভব। কারণ সরকার দূরদর্শিতার অভাবে তাদের আস্তিনের পেছনের দিক থেকে খামচে ধরে ভাবছেÑ জনগণ এতে বাহবা দিচ্ছে! না, বাহবা দিচ্ছে না প্রতিটি মন্দ আচরণকে ভালোভাবে আমলে নিচ্ছে। এর ফল আখেরে নেতিবাচকই হওয়ার কথা।
সরকার উন্নয়নের ফিরিস্তি দেখিয়ে যখনই মাঠে নামবে, তখন ব্যর্থতার সূচকগুলোও আড়ালে থাকবে না। তাই মাঠ বলবে ভিন্ন কথা। ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব দেখাবে অন্য সূচক। বোতাম টিপে পার পাওয়ার সময়টা পার হয়ে গেছে। নির্লিপ্ত থাকলেও জনগণের যেমন রেজিস্ট্যান্স পাওয়ার বেড়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সব প্রতিপক্ষের জমাখরচের হিসাব ও তালিকা প্রস্তুত থাকার কথা।

সমস্যা হচ্ছে সরকার যখন একটা চাপে পড়ে তখন সেটাকে নিষ্পত্তি না করেই নতুন চাপ মোকাবেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে সরকারের অগ্রাধিকারগুলো হারিয়ে না গেলেও গুরুত্ব হারায়। এটা কোনো রাজনৈতিক দল ও সরকারের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। দেশের ক্ষেত্রেও এমনটি গ্রহণীয় নয়।
একটা উপমা নিন, সুষমা স্বরাজ এলেনÑ সাউথ ব্লকের বেঁধে দেয়া কুণ্ডলীর বাইরে একটা শব্দও বললেন না। মাপা শব্দে কথা বলে উৎরে গেলেন। কারণ, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা হোমওয়ার্কটাই এমন। সুজাতা সিং কূটনীতিক হিসেবে অভিনয়টা করেছেন আনকোড়াভাবে। আর সুষমা দক্ষ অভিনেত্রীর ভূমিকা পালন করে গেলেন। তিনি রাজনীতি কতটা বুঝেন সেটা গৌণ, কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকদের করা হোমওয়ার্কটা আত্মস্থ করে বাংলাদেশ ‘জয়’ করে গেলেন। অথচ ভারত এক রত্তিও ছাড় দিলো না। ছাড় দেয়ার ক্ষমতাও তার নেই। ভারতের নেইভার ডকট্রিন এক দিনে তৈরি হয়নি। এক দিনে পাল্টেও যাবে না। তাই হোমওয়ার্কের মাধ্যমে কূটনৈতিক কথাবার্তার ফাঁকে সবাইকে স্বস্তির একটা আবহের মধ্যে ফেলে দিলেন, এমনকি খালেদা জিয়ার সাথে কথা বলার সময়ও তিনি তার দেশের স্থায়ী ও নির্ধারিত পলিসির বাইরে গেলেন না। কারো সাথে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। আছে একধরনের নীতিকথার ফুলঝুরি। আমাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও পররাষ্ট্রবিষয়ক চিন্তকেরা যখন বুঝলেন ‘দিদি বলেছেন দেবেন’ কিন্তু দেননি, বরং কিছু নিয়েছেন। এই সত্য যখন বুঝলেন, তখন আর কিছু করার রইল না।

রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু ও বন্ধু যেমন নেই, তেমনি পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতিতেও স্থায়ী শত্রু-বন্ধু নেই। রাজনীতি যেমন কৌশলের নীতি, তেমনি পররাষ্ট্র ও কূটনীতিও। একই বিষয়ে দু’জনকে সমান খুশি করা বা রাখা সম্ভব নয়। তাই কাউকে খুশি করে কাউকে বশে রাখতে হয়। কাকে খুশি করে কাকে বশে রাখা যাবে এসব ব্যাপারে সরকারের কোনো হোমওয়ার্কই নেই।
সামনের দিনগুলোয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ আরো দ্রুত ধেয়ে আসবে। যোগ হবে বাইরের চাপ ও চাহিদা চাপে থেকেও নিজেদের সামর্থ্য সক্ষমতা ও আস্থার জায়গাটা মেরামতের ওপরই নির্ভর করবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। সেই সাথে গণতন্ত্রের অধরা সোনার হরিণটার ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
masud2151@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/263042