২৫ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৫

দখলের বাকি শুধু নগর ভবন

বাইরে উচ্ছেদে তৎপর আঙিনায় নজর নেই

রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তাগুলোকে চলাচলের জন্য নির্বিঘ্ন রাখতে বিভিন্ন সময় নানা তৎপরতা দেখিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। অথচ এই সিটি করপোরেশনের প্রধান দপ্তর ফুলবাড়িয়ার নগর ভবনেরই গা ঘেঁষে চলছে অবৈধ দখলের হিড়িক।
নগর ভবনের রাস্তা, পেছনের গেট, পাশের পুলিশ সদর দপ্তর, আরেক পাশের ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর, বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতি কমপ্লেক্স, ফুলবাড়িয়া সিটি সুপারমার্কেট, হানিফ ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাগুলোর সামনে আশপাশের সব রাস্তা ও ফুটপাত এমনভাবে বেদখল হয়েছে যে যেন নগর ভবনটিকেই দখলদারদের হাতে তুলে দিতে বাকি রেখেছেন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সেখানে শুধু একটি রাস্তার দখলদারদের কাছ থেকেই আদায় করা হয় বছরে ৩০ লাখ টাকা। নগর ভবন ঘিরে সব রাস্তা থেকে বছরে কোটি টাকার ওপরে চাঁদা তোলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এর পেছনে রয়েছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। ফলে সারা দক্ষিণ সিটিতে দখলদারের দিকে নজর দিলেও নিজেদের আঙিনায় চোখ বন্ধ করে রেখেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। দখলদার থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। ফুটপাত ছাড়িয়ে এসব দখলদার রাস্তায় চলে এসেছে। শত শত দোকান আর অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রাস্তা। সেখানে হেঁটে চলারও উপায় নেই।
নগর ভবনের পাশপাশি পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়াল ঘেঁষেও অবৈধ দখল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব দোকান থেকে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ মাসিক অর্থ পেয়ে থাকে। তাই বছরের পর বছর ধরে মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ থাকলেও তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আর দৈনিক ভিত্তিতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও অর্থ পেয়ে থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেটের সামনের রাস্তায় কমপক্ষে ৫০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানে পাইকারি ও খুচরা কাপড় বিক্রি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা এসে এসব দোকান থেকে মালামাল সংগ্রহ করছে। দোকানের বেশির ভাগ আবর্জনা বস্তায় ভরে রাস্তায় রেখেছে দোকানিরা। ফলে তিন লেনের এ সড়ক দিয়ে এক লেনেও যানবাহন চলাচল দায় হয়ে পড়েছে। একটি যানবাহন কোনোভাবে দাঁড়িয়ে গেলেই মুহূর্তে পুরো এলাকায় যানজট লেগে যায়।
রাস্তায় দোকান নিয়ে বসার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাকিব হোসেন নামের এক কাপড় ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ রাস্তা খুব একটা ব্যবহার হয় না। এখানে ৪০-৪৫টি দোকান সিটি করপোরেশনকে ম্যানেজ করে কয়েক বছর আগে বসানো হয়েছে। প্রায় ২০ বর্গফুটের এসব দোকানের প্রতিটির মাসিক ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। আর দৈনিক দিতে হয় ৫০ টাকা পুলিশকে। এর পরও মাঝেমধ্যে কিছুটা ঝামেলা হয়। ’ এই ব্যবসায়ীর তথ্য অনুযায়ী ৪৫টি দোকান থেকে প্রতি মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে আদায় হলে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ওঠানো হয়। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সামনের রাস্তারও একই অবস্থা। সেখানে রাস্তায় পার্ক করা হয়েছে অনেক যানবাহন। লাঠি হাতে নিয়ে এসব যানবাহন থেকে এক যুবককে অর্থ আদায় করতে দেখা গেছে। প্রভাতী বনশ্রী, ঢাকা লিংক, গ্রামীণ শুভেচ্ছা, শুভযাত্রা ও আজমেরী গ্লোরী পরিবহনের বাসগুলো তাদের স্থায়ী স্ট্যান্ড হিসেবে এই রাস্তা ব্যবহার করছে। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে এসব গাড়ির চালকরা কেউ বিশ্রাম নিচ্ছেন, আবার কেউ খাবারের জন্য হোটেলে গেছেন। চালকের সহকারীরা যাত্রীদের ডাকাডাকি করে গাড়িতে ওঠানোর কাজে ব্যস্ত।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের অংশে কয়েকটি খাবারের দোকানও রয়েছে। এসব দোকানেও জমজমাট অবস্থা। ত্রিপল দিয়ে বাঁশের খুঁটির সাহায্যে ঘর তৈরি করে স্থায়ীভাবেই বসেছে এসব দোকান। খাবারের দোকানগুলো থেকে আশপাশ এলাকায় ফেলা হচ্ছে ময়লা। এসব ময়লা-আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। খাবারের দোকানের সঙ্গে রয়েছে বেশ কয়েকটি গাড়ির গ্যারেজ। এসব গ্যারেজ রাস্তার মিডিয়ানে বসানো হলেও তাদের যানবাহন মেরামতের কাজটি হচ্ছে রাস্তায়।
বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতি কমপ্লেক্স থেকে একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ে ডিএসসিসির পেছনের প্রবেশপথ। সেখানে লেখা রয়েছে—‘গেটের সামনে কেউ দোকান বসাবেন না’। কিন্তু গতকাল বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, দুই-তিনটি দোকান গেটের সঙ্গে মিশিয়ে বসানো হয়েছে। এর পাশের ফুটপাতে আশপাশের লোকজন খোলা পরিবেশে মূত্র ত্যাগ করছে। আবার গেটের পূর্ব পাশে একটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা খুবই অপরিষ্কার। সেখানে টয়লেটের নোংরা পানি গড়িয়ে রাস্তায় আসছে। পথচারীরা চলাচলের সময় এখানে এসে বেশ বিরক্তি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। অনেকেই নগর ভবনের সামনের এ অব্যবস্থাপনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
ফুলবাড়িয়া সিটি সুপারমার্কেটের সামনের অংশে ফুটপাতে ৯টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দোকান নির্মাণ করে তা বিক্রি করে দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি আওলাদ হোসেন। এসব দোকানের জন্য সেখানে ফুটপাতের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ফুটপাত বা রাস্তায় কোনো দোকান বরাদ্দ দিই না। মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে বলে সেগুলো দূর করতে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে থাকি। এখন কোনো ব্যক্তি যদি সিটি করপোরেশনের নামে অর্থ আদায় করে থাকে তা আমাদের নজরে আসেনি। ’ তিনি বলেন, ‘নগর ভবনের পাশের রাস্তায় যেসব বাস রেখেছে তা সরানোর জন্য পরিবহন নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। তাঁরা কিছুটা শৃঙ্খলায় এসেছেন। পুরোপুরি শৃঙ্খলা আনা কিছুটা সময়ের ব্যাপার। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/10/25/557560