২৫ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৯

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের বড় ঋণ আদায়ে স্থবিরতা

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দেয়া বড় অঙ্কের ঋণ আদায়ে অনেকটা স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৬ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৪৮ শতাংশই দেয়া হয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণধারীদের। কিন্তু এসব ঋণ গ্রহিতার কাছ থেকে সময় মতো ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দেয়া।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ২০১৫ সালে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল মোট ঋণের ২৯ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয় ৩১ শতাংশ এবং চলতি ২০১৭ সালের পর্যন্ত এই হার আরো বেড়ে হয়েছে ৩৫ শতাংশ। একইভাবে ভাবে জনতা ব্যাংকের ২০১৫ সালে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ছিল ১৩ শতাংশ, তার পরের পর বছর কমে ১১ শতাংশ হলেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তা আবারো বেড়ে হয়েছে ১৪ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকে এই হার যথাক্রমে ২২, ২৫ ও ২০ শতাংশ। রুপালী ব্যাংকে ১৭, ১৭ ও ২৭ শতাংশ। বেসিক ব্যাংকে ৫১, ৫৪ ও ৫৩ শতাংশ। বিডিবিএলে ৩৮, ৫০ ও ৫২ শতাংশ। এসব শ্রেণিকৃত ঋণের বেশির বেশির ভাগই রয়েছে বড় বড় ঋণ গ্রাহকদের হাতে।

বিআইবিএমের ‘ক্রেডিট অপারেশনস অব ব্যাংকস-২০১৬’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো মাত্র ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ গ্রাহকের কাছে ঋণ দিয়েছে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রাহকদের কাছে গেছে ১৭ শতাংশ ও এক কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রাহকদের কাছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। তবে ব্যাংকগুলোর ৪৭ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণ রয়েছে ২০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহণকারী গ্রাহকদের কাছে।
দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালীর মোট বিতরণকৃত ঋণের ৭০ শতাংশই রয়েছে মাত্র ১২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। ২০১৬ সাল শেষে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকটির পাওনা ছিল ১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শীর্ষ ১২ গ্রাহকের মধ্যে আটটি সরকারি ও চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই ঋণের বেশির ভাগই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। এর বাইরে ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার ঋণ। ফলে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতার অবস্থাও সোনালী ব্যাংকের মতো। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে শীর্ষ ১২ গ্রাহকের কাছে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। যদিও একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ৩৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ ১৩ গ্রাহকের কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ১১২ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

একই অবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকও। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ১৭ জন শীর্ষ গ্রাহকের কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে মোট ১৬ হাজার ৮৮১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকটি। জুন শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।
বড় গ্রাহকের ঋণ দিয়ে আরো বেকাদায় আছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক, বিডিবিএল ও কৃষি ব্যাংক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপিঋণ ছিল সাত হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। বিডিবিএলের ৭৬০ কোটি টাকা। একই সময়ে বিকেবির শ্রেণিকৃত চার হাজার ৩২০ কোটি টাকা ও রাকাবের ছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শ্রেণিকৃত বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বড় ঋণ গ্রহিতাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য আমরা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন সময় তাগাদা দিয়েছি। কোনো কোনো সময় ডেডলাইনও দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বড় গ্রাহকদের কাছ থেকে সন্তোষজনকভাবে ঋণ আদায় করা যাচ্ছে না। এরা খুব প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকগুলোকে ঋণ আদায়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/262909