সরকারি মালিকানার ৩১টি প্রতিষ্ঠান গত অর্থবছরে দুই হাজার ৪১৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এর মধ্যে টেলিটকের লোকসান ২৪৬ কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানা লোকসান দিয়ে আসছে। এসব অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিভিন্ন সময় সরকার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কারখানাগুলো বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান মুনাফা করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করতে পারে না। বেসরকারি গ্রামীণফোন বা রবি একচেটিয়া ব্যবসা করলেও সরকারি টেলিযোগাযোগ সংস্থা টেলিটক লোকসান দেয়।
গতকাল অনুমোদিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, লোকসানি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে কৃষি ব্যাংক।
এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৫১১ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরেও এ প্রতিষ্ঠান লোকসানের শীর্ষে ছিল। ৪৩৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ২৪৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে টেলিটক লোকসানি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
লোকসানের কারণ জানতে চাইলে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. গোলাম কুদ্দুস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টেলিটকের বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন কম। এ কারণে আমরা গ্রাহকসংখ্যা বাড়াতে পারি না। নেটওয়ার্ক না থাকলে তো গ্রাহক বাড়ানো যাবে না। এ কারণে মূলত টেলিটক লোকসান দিচ্ছে। এই লোকসান থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এসংক্রান্ত কাজের জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। শিগগিরই কাজ শুরু হবে। ’
এ ছাড়া শাহজালাল ফার্টিলাইজার কম্পানি লোকসান দিয়েছে ১৯৭ কোটি টাকা। ১২৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ৯৮ কোটি টাকা, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কম্পানি ৩৪ কোটি টাকা এবং আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কম্পানি ৩১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। চিনিকলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল। এ মিলের লোকসান প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া কুষ্টিয়া সুগার মিল ৩০ কোটি টাকা, ফরিদপুর সুগার মিল ২৮ কোটি, জিল বাংলা সুগার মিল ২১ কোটি, পাবনা সুগার মিল ৩২ কোটি, মোবারকগঞ্জ সুগার মিল ১৬ কোটি, নাটোর সুগার মিল ৩৩ কোটি, রাজশাহী সুগার মিল ৩৪ কোটি, জয়পুরহাট সুগার মিল ২৬ কোটি, রংপুর সুগার মিল ২৮ কোটি, শ্যামপুর সুগার মিল ১৫ কোটি, সেতাবগঞ্জ সুগার মিল ২৬ কোটি, ঠাকুরগাঁও সুগার মিল ৩১ কোটি এবং পঞ্চগড় সুগার মিল ২৫ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন প্রায় ১০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কর্ণফুলী পেপার মিলসের লোকসান ৬৬ কোটি টাকা। ছাতক সিমেন্ট কম্পানি লোকসান দিয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইন্সুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি পাঁচ কোটি এবং উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি ৯ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) আট কোটি এবং এলপি গ্যাস লিমিটেড ৫০ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই লোকসানগুলোকে দুই ভাবে দেখা যায়। কিছু প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয় উৎপাদিত পণ্যের দাম কম ধরার কারণে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখে যথাযথ দাম ধরা হয় না। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের লোকসানও কমানো যেতে পারে। দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। আর কিছু প্রতিষ্ঠান শুধুই অদক্ষতার কারণে লোকসান দেয়। বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কম্পানিগুলো ভালো চলছে। সেখানে টেলিটকের বেহাল দশা। এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হলে অদক্ষতা দূর করতে হবে। এসব সংস্থার শেয়ার বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। অথবা মালিকানা সরকারের হাতে রেখে পরিচালনার দায়িত্ব বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দিতে হবে। তা না হলে জনগণের করের পয়সা দিয়ে এসব লোকসানি প্রতিষ্ঠান পুষতে হবে।
লাভজনক প্রতিষ্ঠান : মন্ত্রিসভা গতকাল ৬১টি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের তালিকাও অনুমোদন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৯ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। লাভজনক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির লাভ করেছে প্রায় এক হাজার ৯৯ কোটি টাকা। আগের বছরের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরের লাভ বেড়েছে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা। এরপরই রয়েছে ব্যাংকগুলোর অবস্থান। জনতা ব্যাংক এক হাজার ৬৩ কোটি, সোনালী ব্যাংক এক হাজার ২০ কোটি ও অগ্রণী ব্যাংক ৭৫১ কোটি টাকা লাভ করেছে। ৬৯১ কোটি টাকা লাভ করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।
অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থা : আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন, ডাকাতি কমলেও অস্ত্র আইন সংক্রান্ত অপরাধ বেড়েছে ৮.৪৬ শতাংশ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেড়েছে ১৭৪টি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে বলে অস্ত্র আইনে মামলা বেড়েছে। এটা পুলিশেরই কৃতিত্ব। এখনো যেসব অবৈধ অস্ত্র রয়েছে সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/10/24/557118