মনু নদীর বাঁধ ভেঙে দ্রুত বেগে পানি নিম্নাঞ্চলে প্রবেশের দৃশ্য : নয়া দিগন্তমনু নদীর বাঁধ ভেঙে দ্রুত বেগে পানি নিম্নাঞ্চলে প্রবেশের দৃশ্য
২৪ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৯

পাউবোর গাফিলতিতে নদীভাঙন হাজার হাজার কৃষকের মাথায় হাতঝুঁকিপূর্ণ মনু নদীর ৪০টি স্পট

মনু নদীর বঁাঁধ ও চাতলা সেতু মেরামতে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের চরম গাফিলতিতে আবারো বঁাঁধভাঙনে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো কুলাউড়ার তিন ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষকে। শরীফপুর, হাজীপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের ৫০ হাজার কৃষকের স্বপ্ন আমনক্ষেত মনুর ভাঙনে তলিয়ে যাওয়ায় এই তিন ইউনিয়নের কৃষকেরা এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছেন। কান্নার রোল পড়েছে কৃষকদের মধ্যে। গত এপ্রিলে বাঁধ ভাঙার ফলে আউশক্ষেতও পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর পাউবো ও সড়ক জনপথ বিভাগ প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বাঁধ ও গার্ড ওয়াল নির্মাণ করার পর চলতি মওসুমে কৃষকেরা অনেক কষ্ট করে আমন ধানের চাষ করেছিলেন। বর্তমানে ধান পাকার সময়ে পুনরায় বাঁধ ভেঙে মনু নদীর পানি কৃষকের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ কড়ে দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোববার ভোরে কুলাউড়া শরীফপুরের চাতলা ব্রিজ ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রামসংলগ্ন এলাকায় মনু নদীর দু’টি প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের ২০টিসহ হাজীপুর ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের মোট ৪০টি গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত হয়ে পড়ে। এসব গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে এবং হাজার হাজার একর রোপা আমনের ক্ষেতসহ অন্যান্য ফসলি ক্ষেত পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। দরিদ্র অসহায় মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৪০০ প্যাকেট ত্রাণ দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বালিয়া, চানপুর, ইছবপুর, লালবাগ ও আশ্রয়গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েক শতাধিক বাড়িঘর এবং বহু ধানী ও অন্যান্য ফসলি জমি ভাঙা বাঁধের পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রায় দুই মাস আগে বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় এখন বাঁধ ভেঙে আমাদের ফসলের ক্ষেত ও বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আশ্রয়গ্রামের জুনেল আহমদ বলেন, তিন বিঘা রোপা আমন ধান চাষ করেছিলেন। ইতোমধ্যে ধানগাছে থোড় এসেছিল, কিন্তু বাঁধ ভেঙে মুহূর্তেই চোখের সামনে জমির সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধসংলগ্ন পাড়ে বসে কান্নায় মূর্ছা যাওয়া গৃহিণী সীমা রানী দে ভাঙনসংলগ্ন পানিতে ডুবে যাওয়া একটি বাড়ি দেখিয়ে বলেন, সর্বনাশা মনু গাঙ (নদী) আমরার একমাত্র মাথাগুজার অবলম্বনটুকু কেড়ে নিচ্ছে। ভোর থেকেই হঠাৎ বাঁধ ভেঙে চোখের পলকেই তার বসতঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। আসবাবপত্রসহ সব কিছুই ঘরের ভেতর রয়ে গেছে, কোনো কিছুই ঘর থেকে বের করে আনতে পারিনি। চার মেয়েকে আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে নদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়েছি আমি আর আমার স্বামী। নদীর পাড়ে আশ্রয় নেয়া একই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম বলেন, পানি ঢুকে আমার বাড়ির কাঁচা দেয়াল ধসে পড়েছে। এখন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনী নিয়ে কই যাবো? দুই দিন ধরে জ্বর। কেউ এখনো পর্যন্ত সাহায্য নিয়ে আসেনি।
নদীর পাড়ে আশ্রয় নেয়া শিরীন বেগম, তালেবুন বেগম, নাজমা বেগম ও মতলিব মিয়া বলেন, পানিতে আমরার মাটির ঘর ভেঙে গেছে। এখন নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে তাকা লাগবো (থাকতে হবে)।

শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জুনাব আলী জানান, চাতলাপুর ব্রিজের বাঁধ ভেঙে এই ইউনিয়নের ইটারগাট, পারিয়ারঘাট, কালারায়েরচর, দত্তগ্রাম, নিশ্চিন্তপুর, মানগাঁও, নসিরগঞ্জ, তিলোকপুর চা বাগান, পালকীছড়া চা বাগান গ্রামসহ ১৬-১৭টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে এবং শরীফপুরের ২৫ হাজার মানুষের আমন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। হাজীপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত বাচ্চু জানান, চাতলাপুর ব্রিজ-সংলগ্ন বাঁধ ভেঙে শরীফপুর দিয়ে হাজীপুরের নি¤œাঞ্চল প্লøাবিত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কেওলার হাওর ডুবে আশপাশের সাতটি গ্রাম আংশিক পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের প্রায় দুই হাজার হেক্টর ধানী জমি তলিয়ে গেছে পানিতে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী মোবাইলে বলেন, প্রতিরক্ষা বঁাঁধ ভাঙনের খবর পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি। আমি রোববার কর্মস্থলে যোগদান করেছি। মনু নদীর বিভিন্ন স্থানে ৪০টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করে বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ঝুঁকপূর্ণ পয়েন্ট সংস্কারের জন্য তিন কোটি টাকা বরাদ্দও এসেছে। এখন টেন্ডার ও ওয়ার্ক অর্ডারের মাধ্যমে কাজ শুরু করা হবে। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/262665