২৪ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৪

ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ

বেকারত্ব পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। জীবন সংগ্রামে অবিরাম যুদ্ধে অনেকে আজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার এ যুদ্ধ আর কত দিন। সরকার বলছে দারিদ্র্যের সংখ্যা কমছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বন্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কাজের সন্ধানে গ্রামের মানুষ ঢাকায় আসলেও কাজ না পেয়ে বেকার দিন কাটছে তাদের। এসব মানুষ প্রতিনিয়ত ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের জালে আটকা পড়েছে ৮৩ লাখ পরিবার। অর্থনীতিতে এর দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কী শহর, কী গ্রাম, কোথাও ভালো নেই সাধারণ মানুষ। সবারই যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তবে শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ বেশি কষ্টে আছেন। গ্রামের মানুষের এ কষ্টের বিষয়টি ফুটে উঠেছে খোদ সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে।

বিবিএস’র সর্বশেষ এই জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ছয় বছরের ব্যবধানে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে খানাপ্রতি আয় বেড়েছে এক হাজার ৮৭৪ টাকা। আয় বৃদ্ধির এ হার ১৬ দশমকি ৩২ শতাংশ। অপরদিকে খানাপ্রতি ব্যয় বেড়েছে চার হাজার ৫৪৪ টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ৪৭ দশমকি ২৭ শতাংশ।

বিবিএস প্রতি পাঁচ বছর পরপর খানা আয়-ব্যয় জরিপ করে থাকে। তবে সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছে ছয় বছর পর। ২০১৬ সালের এ জরিপ অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে খানাপ্রতি আয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। এর বিপরীতে খানাপ্রতি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে খানাপ্রতি যে আয় হচ্ছে ব্যয় তার থেকে ৮০৩ টাকা বেশি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের আয়-ব্যয়ের যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট গ্রামের মানুষ ঋণ করছে। এই ঋণের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি বিনিয়োগে অর্থ ব্যয় হয় তবে সেটা ভালো লক্ষণ। যদি এই অর্থ ভোগের পেছনেই যায় তাহলে সেটা কিছুতেই ভালো লক্ষণ না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হওয়ায় এটি স্পষ্ট যে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ঋণ করছে। এ ঋণ হতে পারে আত্মীয়স্বজন বা এনজিও থেকে। যদি তারা এ ঋণের টাকা বিনয়োগে ব্যয় করে তাহলে এটি তাদের জন্য ভালো। কারণ এটি থেকে ভবিষ্যতে তাদের বেনিফিট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা দারিদ্র্যবান্ধব না। এ জন্য শহর ও গ্রাম সব জায়গায় মানুষের আয়বৈষম্য বাড়ছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। তাই জরিপ অনুসারে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। শহরের মানুষের আয় কিছুটা বাড়লেও ব্যয় তার কাছাকাছি। আয় ও ব্যয় সমান সমান হলে কিংবা আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হলে মানুষ কীভাবে ভালো থাকে?

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্রামাঞ্চলের অনেকেই বিভিন্ন ঋণ প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত। সে কারণে হয়তো আয়-ব্যয়ের পার্থক্য হতে পারে। তবে গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত সঞ্চয় হচ্ছে না। সঞ্চয়ের এ নেতিবাচক প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আয়বর্ধক কাজে জড়িত করতে হবে।

তিনি বলেন, এটি হলো গড় হিসাব। এই হিসাবের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। যাই হোক এখন গ্রামাঞ্চলের মানুষকে আয়বর্ধক কাজে জড়িত করে তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

এদিকে বিবিএস’র প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে ২০১৬ সালের জরিপে খানাপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৬৫ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৬৯৭ টাকা। ২০১০ সালে শহরাঞ্চলে খানাপ্রতি মাসিক আয় ছিল ১৬ হাজার ৪৭৫ টাকা এবং ব্যয় ছিল ১৫ হাজর ৫৩১ টাকা।

২০১৬ সালের জরিপে জাতীয় পর্যায়ে (গ্রাম-শহর মিলিয়ে) খানাপ্রতি মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৯১৫ টাকা। ২০১০ সালে জাতীয় পর্যায়ে খানাপ্রতি মাসিক আয় ছিল ১১ হাজার ৩৫৩ টাকা এবং ব্যয় ছিল ১১ হাজর ২০০ টাকা।

জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে প্রায় তিন হাজার প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে ম্যাক্রোকেডিট রেগুলেটরি অথরিটি(এমআরএ) কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬০০। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রায় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের জটে আটকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইচ্ছা করলেও তারা আর এসব এনজিও থেকে বেরুতে পারছে না।

গ্রামীণ ব্যাংক ২৫৬৪টি শাখার মাধ্যমে দেশের ৮১ হাজার ৩১৭টি গ্রামে ৮৩ লাখ সদস্যকে ঋণের জালে আটকে ফেলেছে। এ খাতে গ্রামীণ ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ ৮ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের উচ্চ হার বাণিজ্যিক ব্যাংকের চাইতেও বেশী।

চালু হওয়ার ৪০ বছর পরও এমন কোন প্রমাণ নেই, যাতে মনে হতে পারে ক্ষুদ্রঋণ গরীব মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে। তবে এটা প্রমাণিত সত্য ঢাকডোল পিটিয়ে যারা এ দেশের গরীব মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে মাঠে নেমেছে, তারা শত শত কোটি টাকার মালিক বনেছে। ক্ষুদ্রঋণ যদি সফল হতো তা হলে আজো কেন ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে? গ্রামীণ ব্যাংকের প্রথম ঋণ গ্রহীতা চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামের সুফিয়া খাতুন বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। চিকিৎসার টাকা যোগাতে তার পরিবারের সদস্যরা দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেছে।

বাংলাদেশের হতদরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ৬৭ শতাংশই ব্যয় করে অনুৎপাদনশীল খাতে, যা দারিদ্র্যবিমোচনে কোন ভূমিকাই রাখে না। তাই ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব নয়। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ আট জেলার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পরিচালিত এক জরিপের প্রতিবেদনে এ তিক্ত সত্য ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি দেশের দুর্যোগপ্রবণ রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, হতদরিদ্র ব্যক্তিদের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশই ঋণগ্রস্ত। এদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ দেনাগ্রস্থ শুধু স্থানীয় মুদি দোকানগুলোর কাছে।

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ২৯ শতাংশ হতদরিদ্র চিকিৎসা বাবাদ খরচ করে ও ১৭ শতাংশ দৈনন্দিন খাবার কেনে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের ১৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মৃতের সৎকার, বিয়ে ও বিবাহ বিচ্ছেদের মতো পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং জরুরি সংকট মোকাবেলায়। হতদরিদ্রের ঋণের উৎস সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬০ শতাংশ মানুষ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নেয়। দাদনের ঋণ নেয় ১০ শতাংশ। এছাড়া ১৪ শতাংশ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে, ৭ শতাংশ ব্রাক থেকে, ১২ শতাংশ বিভিন্ন এনজিও থেকে ও মাত্র ১ শতাংশ সাধারণ ব্যাংক থেকে।

এন.জি.ও দের অর্থের যোগানদাতা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। পৃথিবীর সর্বত্র তাদের নেটওয়ার্ক সক্রিয়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ, খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার, ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ, নতুন মধ্যসত্ব শ্রেণী তৈরি করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুঁজি পাহারা দেয়া তাদের লক্ষ্য।

বিমল চন্দ্র হাওলাদারের জীবন কাহিনী থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না গ্রামের মানুষ কেমন আছে। বিমল চন্দ্র হাওলাদার (৫২)। পেশায় একজন কৃষক। বাড়ি পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার মুরাদিয়া গ্রামে। কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসা। একসময় গ্রামে কৃষি কাজ করতেন তিনি। বর্ষা কালে গ্রামে কাজ না থাকায় ঢাকায় এসেছেন বিমল। এ সময় তিনি কাঠমিস্ত্রীর কাজও করেছিলেন। তাই রাজধানীতে কাঠমিস্ত্রীর কাজের সদ্ধান করছেন তিনি। কিন্তু কাজ না পাওয়ায় দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে সংসার ভালো কাটছে না বিমলের। গ্রামে কাজ না পেয়ে একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নেয় বিমল। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না তিনি। সংসাদ আর ঋণের কিস্তি চালাতে ঢাকায় কাজের সন্ধানে আসে বিমল। ঢাকা এক সপ্তাহে কাজ পায়নি বিমল। ঋণের জালে আটকা বিমল এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। তিনি বলেন, দিনে তিন বেলা খাওয়ার পরিবর্তে এক বেলা খেয়ে থাকা যায়। কিন্তু ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা না হলে বাড়ি থেকে গরু-ছাগল নিয়ে যাবে এনজিও লোকেরা। তাই কাজ তাকে করতেই হবে।

তাই কাজে সন্ধানে প্রতি দিনই যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা মোড়ে ব্রীজের গোলচত্তরে আসেন বিমল। কিন্তু কাজ না পেয়ে সকাল ১১টা পর্যন্ত বসে থেকে চলে যান তিনি। থাকেন ব্রীজের নীচে ফুটপাতে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন চলবে বিমলের জীবন।

বিমলদের মত অনেকেই ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন। লাখ লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। কাজ চাইলেও তারা কাজ পাচ্ছে না। দিনের পর দিন ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। তাদের অর্থ দেনা এভাবে আর কত দিন চলবে। গরীব আর ধনীতে এভাবেই বৈষম্য বাড়ছে। অথচ সরকারের পরিসংখ্যান বলছে দারিদ্র্যের পরিমাণ কমছে। হয়তো বিমলরাও সরকারের খাতায় দরিদ্র নয়।

http://www.dailysangram.com/post/304690