২৪ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১২

জাতি এরূপ উন্নয়ন চায় নাসুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

আমাদের জাতীয় বাজেট বরাদ্দের একটি বড় অংশ উন্নয়নের পেছনে ব্যয় হয়। বাজেটের টাকার প্রধান উৎস জনসাধারণের দেয় কর। অতীতে উন্নয়ন বাজেট বিদেশী অনুদাননির্ভর ছিল। বর্তমানে উন্নয়ন বাজেটে বিদেশী অনুদানের পরিমাণ এতই কম যে, এটি গুরুত্বহীন। উন্নয়ন বাজেটের অর্থ দিয়ে যেমন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়; আবার এ বাজেটের অর্থ এগুলোর আধুনিকায়ন ও সংস্কারের পেছনেও ব্যয় হয়। দেশের বিভিন্ন শহরের অভ্যন্তরস্থ সড়ক ও ভূগর্ভস্থ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বরাবর বার্ষিক উন্নয়ন খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয় এগুলো সংস্থাগুলোর প্রাত্যহিক কাজ।

উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজে যেসব সামগ্রী ব্যবহার হয় এর মধ্যে অন্যতম হলো ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর, রড প্রভৃতি। বালু ও পাথর সরাসরি প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণ করা হয়। অপর দিকে ইট, সিমেন্ট ও রডের নির্মাণ উপকরণ প্রাকৃতিক উৎস হতে আহরণ-পরবর্তী হস্তসাধিত ও যান্ত্রিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সড়ক ও মহাসড়ক নির্মাণে যে বিটুমিন ব্যবহার করা হয় এটিও প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরণ-পরবর্তী যান্ত্রিক উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। যেকোনো ধরনের উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের সাথে বাঁশ ও কাঠের ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। উভয় ধরনের সামগ্রী প্রকৃতি থেকে আহরণ করা হয়।
আমাদের দেশে উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের একটি বড় অংশ লোপাট হওয়ায় এগুলো খুবই নি¤œমানের হয় এবং বছর না ঘুরতেই এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য পুনঃঅর্থ বরাদ্দের আবশ্যকতা দেখা দেয়। উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের অর্থ লোপাটের সাথে বরাদ্দকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ সম্পৃক্ত কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সবাই জড়িত। সম্প্রতি একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের অর্থ বরাদ্দের ছাড় পেতে মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যে সামগ্রিক বরাদ্দ করা অর্থের ২০-৩০ শতাংশ অগ্রিম উৎকোচ হিসেবে প্রদান করতে হয়, তা গণমাধ্যমকর্মী ও নগরবাসীর সামনে অবলীলায় প্রকাশ করেন। প্রকাশকালে তিনি আরো ব্যক্ত করেন, এ ধরনের অর্থ দেয়ার জন্য তাদের নিজস্ব কোনো তহবিল না থাকায় বাধ্য হয়েই তাদের ঠিকাদারের দ্বারস্থ হতে হয় এবং যে ঠিকাদারের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাহিদা মেটানো হয়; পরে ওই ঠিকাদারকে কাজ দেয়া বাধ্যবাধকতার মধ্যে আবদ্ধ বিধায় দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়াটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঙ্গের অন্যতম বিচার বিভাগের প্রধান সম্প্রতি একটি জেলা শহর ভ্রমণকালে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলেন, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের ৪০ শতাংশ অর্থ দিয়ে কাজ সমাধা করা হয় এবং বাকি অর্থ লোপাট হয়। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত সরকারের জনৈক মন্ত্রী কথাচ্ছলে বলেন, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের বরাদ্দ করা অর্থের বড় অংশ এমপিদের পকেটে ঢোকে। উন্নয়ন ও সংস্কার প্রকল্প সংশ্লেষে দেশের দুর্নীতির মাত্রা এত ব্যাপক যে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদধারী রাষ্ট্রপতি তার নিজ এলাকা সফরকালে জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা দুর্নীতি না করলে অধীনস্থ কর্মকর্তারা দুর্নীতি করার সাহস পাবেন না। রাষ্ট্রপতির দুর্নীতিবিষয়ক উক্তিটি দেশের সামগ্রিক দুর্নীতির আলোকে করা হলেও উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের দুর্নীতির বিষয়টি যে এর আওতাবহির্ভূত নয়, এ প্রশ্নে কোনো সংশয় নেই।
অতি সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সাথে মতবিনিময়কালে তাদের যে ১৩ দফা নির্দেশনা দেন, এর প্রথম দফাতে তিনি দুর্নীতির মাত্রা কমানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ১৩ দফা নির্দেশনার প্রথম দফায় দুর্নীতির বিষয়টি স্থান পাওয়ায় দেশের সামগ্রিক দুর্নীতির সূচকের মাত্রা নি¤œমুখী না হয়ে যে ঊর্ধ্বমুখী এ সত্যটি আজ ফুটে উঠেছে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো সংশ্লেষে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বিদ্যমান উন্নয়ন প্রকল্পের সংস্কারসাধন করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজ অনুমোদন হওয়ার সময় এর ব্যয় ও বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করে দেয়া হয়। আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর অন্যত্র একই ধারা পরিলক্ষিত হয়; তবে পৃথিবীর অন্যত্র বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়ার সময় যে ব্যয় ও সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয় এর কোনোটিই অতিক্রমের ঘটনা দেখা যায় না। এমন অনেক উন্নত দেশ রয়েছে যেখানে প্রাক্কলিত ব্যয় ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়টিকে দেশ ও জাতির সামর্থ্যরে অংশ হিসেবে দেখে এটিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ করার প্রয়াস নেয়া হয়।

আমাদের দেশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ব্যয়ভার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে নির্বাহ করা হয়। বৈদেশিক সূত্র থেকে গৃহীত অর্থ ঋণ বা অনুদান হয়ে থাকে। ঋণ হয়ে থাকলে সুদসহ ফেরত দেয়ার আবশ্যকতা থাকে। অপর দিকে অনুদান হয়ে থাকলে সাধারণত পরামর্শকসেবা ও সরঞ্জামাদি দাতা দেশ বা সংস্থার শর্তাধীন হয়ে থাকে। অতীতে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে হারে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের আবশ্যকতা ছিল, বর্তমানে তা বহুলাংশে হ্রাস ঘটেছে। বিষয়টি ইতিবাচক হলেও আমাদের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয়ের বহুলাংশে বৃদ্ধি ঘটে। বাস্তবায়ন বিলম্বন যে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির মানসে করা হয় এটি আজ আর গোপন কিছু নয়। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির অর্থ যতটুকু না প্রকল্প সংশ্লেষে ব্যয় হয়, এর অনেক বেশি যে প্রকল্প অনুমোদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকাজে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং নির্মাণ ঠিকাদারের পকেটস্থ হয় এ সত্যটি আজ কারো অজানা নয়।
উন্নয়ন প্রকল্পের বেশির ভাগ নির্মাণ ঠিকাদার বিশেষত মহাসড়ক, উড়াল সেতু ও দীর্ঘাকৃতির সেতুর নির্মাণ ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রকল্প অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে যেকোনো পর্যায়ে অমূলক অজুহাতে নির্মাণকাজ বন্ধ করে চলাচলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকল্পকাজের ব্যয় বৃদ্ধির অবতারণা ঘটানোর প্রয়াস নেয়। এই ব্যয় বৃদ্ধির প্রায় সাকুল্য অর্থ প্রকল্প অনুমোদন ও তত্ত্বাবধানের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি এবং ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এটি উপরি উক্ত সবার দুর্নীতিলব্ধ আয় এবং এ ধরনের দুর্নীতি দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয়ভারের বেশির ভাগের জোগান আসে জনগণের দেয়া কর থেকে। জনগণ দেয় করের অর্থ অপব্যয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ যেকোনো দেশ ও জাতির জন্য দুঃখজনক ও বিড়ম্বনার কারণ। এ ধরনের অপব্যয় ও আত্মসাতের সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় না আনা গেলে এর রোধ না হয়ে তা বেড়েই চলবে। বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা গেছে, একটি ক্ষমতাসীন সরকারের বিদায়-পরবর্তী অপর ক্ষমতাসীন সরকার এ ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হয় কিন্তু আমাদের দেশের মামলা তদন্ত ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় দেখা যায় উভয়টি বা যেকোনোটি শেষ হওয়ার আগেই যে সরকার কর্তৃক তদন্ত বা বিচারের কার্যক্রম গৃহীত হয়, সে সরকারের বিদায় ঘটে।

সর্বশেষ ঘোষিত বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের বেতন ও ভাতার ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধির মাত্রা ১২৩ শতাংশ। এ বৃদ্ধির মাত্রা সার্বিক পরিসরে এত ব্যাপক যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে এ ধরনের বৃদ্ধি পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। বেতন বৃদ্ধি-পরবর্তী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যেমন আনন্দে উদ্বেলিত; অনুরূপ দেশবাসীর মধ্যেও আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে নিঃস্বার্থ সেবা পাবেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে দেশবাসীকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছে সেবা পেতে আগের তুলনায় আরো অধিক পরিমাণ অর্থ উপরি বা উৎকোচ হিসেবে দিতে হয়।
আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তির জনগণের সেবা দিতে সচেষ্ট থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত বেশির ভাগ ব্যক্তি যে সংবিধানের এ নির্দেশনা থেকে বিচ্যুত সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই আছে, যাদের সে অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে।
উপরোল্লিখিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের অর্থ লোপাটের যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে, তা দেশের জন্য খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এই দুর্নীতির চিত্র থেকে ধারণা পাওয়া যায়, বর্তমানে মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বেশির ভাগের মধ্যে নীতি ও নৈতিকতার কোনো বালাই নেই।

দেশে বর্তমানে যে সামগ্রিক দুর্নীতির চিত্র, এর বড় অংশই উন্নয়ন ও সংস্কারসংশ্লিষ্ট। উন্নয়ন ও সংস্কারের অর্থের বড় অংশ লোপাট হলে সে উন্নয়ন দেশ ও অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে। তা ছাড়া উন্নয়ন ও সংস্কারের উপকরণ প্রকৃতি থেকে আহরিত হওয়ায় এর আহরণ যত বেশি হবে প্রকৃতি তত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের ক্ষতির মাত্রা অসহনীয় পর্যায় গেলে তা বিপর্যয় বয়ে আনে। আমাদের উন্নয়ন ও সংস্কারের অর্থ লোপাট এবং প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণ নিয়মনীতি-বহির্ভূত কিংবা জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতার মধ্যে না থাকার কারণে সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন ও সংস্কার দেশ ও জনগণের জন্য সুফল বয়ে না এনে বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর উন্নয়ন ও সংস্কারসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি রোধ করা না গেলে সে বিপর্যয়ের ভয়াবহতা সমূলে আমাদের সব অর্জনকে যে গ্রাস করবে, অন্তত এ সত্যটুকু উপলব্ধি করে এর লাগাম টেনে ধরা জরুরি নয় কি?হ
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/262584