২৪ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১২

জামায়াত আমীরসহ নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার হিংসার পথ পরিহার করুন

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব মকবুল আহমাদ, নায়েবে আমীর মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ দলটির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ৮/৯ জন নেতা গত ৯ অক্টোবর কিছু দলীয় ইস্যু আলোচনার লক্ষ্যে ঢাকার উত্তরায় একটি বাড়িতে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। বিষয়টি গোয়েন্দা পুলিশের নজরে যায় এবং তারা পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট জামায়াত নেতৃবৃন্দ, তাদের বহনকারী ড্রাইভার সাইফুল ইসলাম এবং বাড়ির মালিককে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে তাদের ডিবি অফিসে নেয়া হয় এবং ঐদিন রাতে ড্রাইভার সাইফুলকে নিয়ে মীরপুরের একটি বাড়িতে হানা দেয়া হয়। পরদিন তাদের আদালতে তোলা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং নাশকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানোসহ বিস্ফোরকদ্রব্য বহনের অভিযোগও আনা হয়। এই অভিযোগে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের বিরুদ্ধে দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অভিযুক্তরা প্রত্যেকটি অভিযোগকেই মিথ্যা ও বানোয়াট বলেছেন। বলাবাহুল্য, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কদমতলী থানার একটি বাড়ি থেকে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ শাখার আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল ও সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদসহ ১০ জন নেতাকর্মীকে নাশকতা সৃষ্টি, সরকার উৎখাত এবং বিস্ফোরক দ্রব্য রাখার দায়ে পুলিশ গ্রেফতার করেন। তাদের ৩০ সেপ্টেম্বর কোর্টে হাজির করা হয়। কিন্তু পুলিশ তথাকথিত অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রকার প্রমাণ দাখিল করতে না পারলেও আদালত তাদের ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এই একই মামলায় আমীরে জামায়াতসহ দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং দশদিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এর নাগরিকদের চলাফেরা, মতামত প্রকাশ, দল বা সমিতি গঠন এবং আইনের আওতায় থেকে তা পরিচালনার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র তাদের এই অধিকারভোগে বাধা নয়, সহযোগিতা করতে বাধ্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, গত ৯ বছর ধরে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সংবিধান প্রদত্ত এই মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করছেন, বিশেষ করে জামায়াত ও তার নেতারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। যেকোনো দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সম্মান করা একটি শিষ্টাচার এই দেশে বহুকাল ধরে চলে আসছিল। কিন্তু এখন আর তা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের দুনিয়া থেকে সরানোর জন্যও সব রকমের অমানবিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এমনকি এই ব্যবস্থাগুলো নরহত্যার সামিল বলেও গণ্য হচ্ছে।
ফিলিপাইনের জাতীয় বীর ড. রিজাল বিশ্বনন্দিত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তার নিরলস সংগ্রামের ফল হিসেবে দেশটি স্পেনীয়দের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের কিছু দল ও নেতৃবৃন্দের আচরণে তিনি ক্ষুব্ধ হন। ক্ষমতায় গিয়ে তারা স্বাধীন ফিলিপিনোদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের উপর নির্যাতন চালাতে শুরু করেছিল। ড. রিজাল তা সহ্য করতে পারেননি, গর্জে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- Why liberty, if the slaves of today become the tyrants of tomorrow? The spainiards rendered the Phillipines into slaves by taking away their basic freedom of speech. freedom of association, freedom of movement and fredom of chosing their own government. After independence you ar doing the same Thing. অর্থাৎ কেন এই স্বাধীনতা। যদি আজকের গোলামরা স্বাধীন হয়ে কালকের অত্যাচারীতে রূপান্তরিত হয়? স্পেনীয়রা ফিলিপাইনবাসীর বাকস্বাধীনতা, সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা এবং পছন্দমত সরকার গঠনের স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকার হরণ করে তাদের গোলামে পরিণত করেছিল। স্বাধীনতার পর তোমরাও তাই শুরু করেছো। ড. রিজালের এই আক্ষেপ আমাদের বেলায়ও প্রযোজ্য। প্রায় পৌন দুশ’ বছর আমরা বৃটিশের গোলাম ছিলাম। আমাদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। তাদের জিঞ্জির ছিঁড়ে আমরা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলাম, কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তাক্ত সংগ্রাম করে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে এই যে, স্বাধীনতার পক্ষ শক্তির দাবিদার যারাই ক্ষমতায় গেছেন তারা দেশকে তাদের জমিদারী শুধু বানাননি, দেশবাসীকে গোলামও বানিয়ে নিয়েছেন। দেশের মানুষ এখন ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে গেলেই অথবা ভিন্নমত পোষণ করলেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং নির্যাতনের শিকারে পরিণত হন। এখন অত্যাচার-নিপীড়নের নতুন নতুন হাতিয়ার ব্যবহারও শুরু হয়েছে। ব্যাপক রিমান্ড তার মধ্যে একটি। এই রিমান্ডের অপব্যবহার পরাধীন বৃটিশ আমলে ছিল না, পাকিস্তান আমলে ছিল না, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল মঈন-ফখরুদ্দীন আমল থেকেই শুরু হয়েছে। বয়স-নির্বিশেষে বিরোধী রাজবন্দীদের উপর তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলতে এখন আর কিছু নেই। নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে কুরআন-হাদীসসহ ইসলামী বইপুস্তককে অপরাধ সামগ্রী হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসলামের অন্যতম ফরজ ইবাদত জিহাদের অপব্যাখ্যা হচ্ছে। তাকে অপরাধের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এমনকি রাষ্ট্রীয় পুলিশবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনেকেই ইসলামী বইপুস্তককে ‘জিহাদী’ বই পুস্তক উল্লেখ করে বাজেয়াপ্ত করছে। এটা শুধু জামায়াত নয়, বাংলাদেশের বিরোধী শিবিরের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা বলে দেশবাসী মনে করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকতে পারে না। ইনসাফের প্রতীক বিচারব্যবস্থাও ধ্বংসপ্রায়। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে আর কেউ যাতে রায় দেয়ার সাহস করতে না পারে সেজন্য প্রাধান বিচারপতিকে দেশত্যাগে বাধ্য করে একটা নজির সৃষ্টি করা হয়েছে।

এই দেশটি নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির নয়, সকল মানুষের। সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হয়েছে। সার্বভৌম জনগণের উপর নিপীড়ন চলতে পারে না। কিন্তু চলছে। বিএনপি, জামায়াত, শিবির, ছাত্রদল মিলিয়ে দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ লোকের বিরুদ্ধে এখন মামলা আছে। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে সন্দেহযুক্ত সাক্ষীর ভিত্তিতে এমনকি সাক্ষীদের গুম করে দিয়ে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। দলটির উপর যে নির্যাতন হয়েছে ইতিহাসে তার তুলনা বিরল।

জনাব মকবুল আহমাদ বর্তমানে জামায়াতের নির্বাচিত আমীর। একজন সজ্জন হিসেবে তিনি নন্দিত একজন মানুষ, সৎ, নিষ্ঠাবান নিবেদিতপ্রাণ ও পরোপকারী ব্যক্তি। এরা দেশেরই সম্পদ। তিনি আমীর নির্বাচিত হবার পর ক্ষমতাসীনরা নড়েচড়ে বসেছিল। এর আগের নির্বাচিত আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসি দিয়ে তারা ভেবেছিলেন জামায়াত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পুনরায় আমীর নির্বাচনের ঘটনা তাদের হতবাক করেছে। জনাব মকবুল আহমাদকেও ফাঁসি দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা তার বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য তার এলাকায় আইসিটি থেকে তদন্ত দল পাঠালো, তারা তন্ন তন্ন করে দেখলো কিন্তু কিছু পেলো না। ফিরে আসলো। কিন্তু সরকার দমলেন না। তারা আবার আরেকটি টিম পাঠালেন। এই টীমটিও তার অপরাধের কোনো চিহ্ন খুঁজে পেলো না। তারা জনাব মকবুল আহমাদের নামে একটি ভুয়া চিঠি তৈরি করে তার অনুকূলে প্রমাণ খুঁজেও ব্যর্থ হলেন। দু’টি টিমই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলো। দীর্ঘদিন তাদের তৎপরতা বন্ধ ছিল। এখন তিনি গ্রেফতার হবার পর তার বিরুদ্ধে পুনঃতদন্ত করে যুদ্ধাপরাধ মামলা দেয়ার জন্য প্রথম টিমের নেতা জনাব নুরুল ইসলামকেই তৃতীয় টিমের নেতা বানিয়ে জনাব আহমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনীতে পাঠানো হয়েছে। তিনিও ফিরে এসেছেন। এলাকাবাসী বলেছেন, ১৯৭১ সালে, তার আগে অথবা পরে তিনি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন না। এখন তদন্ত টিম কি রিপোর্ট দেন আমরা তার অপেক্ষায়ই আছি। কেউ কেউ বলছেন, মিথ্যাচারের দিক থেকে এই সরকার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তারা যেকোনো কিছু করতে পারেন। কি করেন তা দেখার বিষয়। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছিল। এত বছর পর তদন্ত কেন? ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো, ’৭৫ পর্যন্ত ছিল। তখন তদন্ত হয়নি কেন? পুনরায় তারা ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসলেন। তদন্ত কাজ শুরু হলো না, এখন সাত অন্ধের হাতি দেখার পরিবেশ যখন সৃষ্টি হয়েছে তখন হাত পা বেঁধে তদন্ত কি ইনসাফের পরিপন্থী নয়। দুনিয়ার যত দেশে যুদ্ধাপরাধ ও তার বিচার হয়েছে সব দেশেই যুদ্ধের সময় থেকেই অপরাধের তথ্য-প্রমাণ যোগাড় হয়েছে এবং তদানুযায়ী বিচার ও শাস্তি হয়েছে। জার্মানি, ভিয়েতনাম, রুয়ান্ডায়ও এটাই ঘটেছে। শুধু বাংলাদেশেই তা ঘটলো না। অপরাধ খোঁজা হচ্ছে, তদন্ত হচ্ছে যুদ্ধের ৪৭ বছর পর। সন্দেহ নেই হিংসা থেকেই এটা ঘটছে। হিংসার পথ পরিহার করার মধ্যেই সবার মঙ্গল।

 

http://www.dailysangram.com/post/304688