২৩ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৮:৫৭

রাখাইন থেকে ‘বাস্তুচ্যুত যারা’ এসেছে তাদের প্রত্যাবাসনেই সমস্যার সমাধান’

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার চতুর্থ যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গণভবনে এ সাক্ষাৎ করেন তিনি। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মারকচিহ্নসমূহ উপহার দেন
# সুষমা তার বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ এড়িয়ে গেছেন

# রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে বাংলাদেশের আহ্বান

সামছুল আরেফীন : দুই দিনের সফরে ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সফরের প্রথম দিনে তিনি ব্যস্ততম সময় কাটিয়েছেন। এ সময় যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে মিয়ানমারের রাখাই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছেন, রাখাইন থেকে ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের’ প্রত্যাবাসনেই রয়েছে সমস্যার সমাধান। এ ব্যাপারে আনান কমিশনের রিপোর্টকে সমর্থন করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়াদের সহায়তার ক্ষেত্রে ভারত অপারেশন ইনসানিয়াতের মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী দেয়া অব্যাহত রাখবে।

গতকাল রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক (জেসিসি) বৈঠক শেষে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে সুষমা স্বরাজ একথা বলেন। বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারে নিধনযজ্ঞের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এই মানুষদের বোঝাতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেননি সুষমা স্বরাজ, রাখাইন রাজ্যের ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিবর্গ’ বলেছেন তিনি।

এর আগে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে সুষমাকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি ঢাকার কুর্মিটোলায় বঙ্গবন্ধু বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে। সেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাসহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাকে স্বাগত জানান। সন্ধ্যা ছয়টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সুষমা স্বরাজ। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তার সৌজন্যে সোনারগাঁও হোটেলে নৈশভোজের আয়োজন করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এছাড়া রাত আটটায় সুষমা স্বরাজ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করেন।

সাংবাদিক সম্মেলনে সুষমা বলেন, রাখাইনে চলমান সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার। এই সমস্যা সমাধানের জন্য রাখাইন থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ফেরত যেতে হবে। এটা পরিষ্কার যে যখন এসব বাস্তুচ্যুত মানুষ রাখাইনে ফেরত যাবে তখনই স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসবে। তাই, রাখাইন সমস্যার সমাধানের জন্য সেখানকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি দরকার। সেটি করতে ভারত তৈরি আছে।

বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানান। বৈঠক শেষে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার জন্য আমরা চেষ্টা করছি যেন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে ফেরত যেতে পারে। সেজন্য আমি ভারতের প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এসময় তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দেওয়ায় ভারতকে ধন্যবাদ জানান।

বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারতের পানি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, পানিসম্পদ আমাদের দুই দেশের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার উপাদান হিসেবে কাজ করবে। আমরা তিস্তাসহ দুই দেশের যৌথ নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা ভারতকে মনে করিয়ে দিয়েছি, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমাদের দুই সরকারের সময়েই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তিনি জানান, বৈঠকে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের সমীক্ষায় ভারতের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

পানিবণ্টন চুক্তি বিষয়ে সুষমা স্বরাজ বলেন, আমাদের দুই দেশের ভেতরে কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ: হোটেল সোনারগাও এ যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ করতে গণভবনে যান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে হবে।

মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও তাদের ফেরত নিয়ে পুনর্বাসিত করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা নাম উচ্চারণ না করে শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার কথা বললেও সন্ত্রাসীদের শাস্তির কথাও বলেন সুষমা।

বিশাল সংখ্যার এই শরণার্থীদের বাংলাদেশের জন্য ‘বড় বোঝা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কত দিন এই ভার বহন করবে। এর একটা স্থায়ী সমাধান হতে হবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রাখার উপর জোর দেন তাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ সময় অন্যানের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সেদেশের পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর এবং ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা।

বৈঠকের শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর ব্যবহৃত কিছু সমরাস্ত্র প্রদানের অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশকে শুভেচ্ছার স্মারক হিসেবে তখন ব্যবহৃত এমআই হেলিকপ্টার, দুটি ট্যাংক, ২৫টি বিভিন্ন অস্ত্র দিয়েছে ভারত। গণভবনের অনুষ্ঠানে ৩৮ ক্যালিবারের একটি সার্ভিস রিভলবার শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন সুষমা স্বরাজ।

আজ সোমবার বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সেরি ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন সুষমা স্বরাজ। সেখানে ভারতের আর্থিক সহযোগিতায় ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। বিকালে ঢাকা ছাড়ার আগে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে তার মতবিনিময় করার কথা রয়েছে।

২০১৪ সালের মে মাসে বিজেপি ক্ষমতায় আসার এক মাস পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। কংগ্রেস-আওয়ামী লীগ সম্পর্কের বিশেষ মাত্রা আর ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের কারণে তাঁর সেই সফরটি নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহল ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে পরের পাঁচ বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ‘বিশেষ মাত্রা’য় কোনো খাদ সৃষ্টি হবে কি না, তা নিয়ে সরকারি মহলে কিছুটা হলেও সংশয় ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটি হবে বাংলাদেশে তার দ্বিতীয় সফর

http://www.dailysangram.com/post/304620