২২ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:২৪

পরীক্ষা শুরুর পরই সচল হয়ে ওঠে নানা ডিভাইস

ঢাবিতে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁসে অভিনব কৌশল


ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর উত্তীর্ণ হলে চুক্তি অনুযায়ী টাকা নেওয়া হয়। বন্দোবস্তটা এরকমই। কিছু টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়। বাকি টাকার 'জামানত' হিসেবে রেখে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের মূল সার্টিফিকেট। পুরো টাকা পরিশোধের পর সেগুলো ফেরত পাওয়া যায়। ডিজিটাল জালিয়াত চক্রের সদস্যরা পরীক্ষা শুরুর পরপরই ভাইবার ও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পান।

এরপর দ্রুত সেগুলোর উত্তর বিশেষ ডিভাইসের মাধ্যমে হলে থাকা পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মূলত তাদের লক্ষ্য থাকে পরীক্ষা শুরুর পরই প্রশ্ন ফাঁস করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদভুক্ত 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গতশুক্রবার গ্রেফতার তিনজন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দেন। গ্রেফতার তিনজন হলেন- ঢাবি ছাত্র .আবদুল্লাহ আল মামুন, মহিউদ্দিন রানা ও পরীক্ষার্থী ইশরাক আহমেদ রাফী। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে গতকাল শনিবার দায়ের করা মামলায় তাদের চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে সিআইডি। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে এসব তথ্য দিয়েছেন।

মামুন ফলিত রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী এবং রানা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষা চলাকালে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে পরীক্ষার্থী রাফিকে আটক করা হয়। ওই সময় তাদের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের ডিভাইস উদ্ধার করা হয়েছে। ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় শুক্রবার পরীক্ষা চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরের দশটি কেন্দ্র থেকে ১২ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের প্রত্যেককে এক মাস করে কারাদণ্ড দেন।

এ ব্যাপারে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ উদ্দিন গতকাল সমকালকে বলেন, ৬ থেকে ৭টি ধাপে প্রশ্ন ফাঁসকারী জালিয়াত চক্র কাজ করে থাকে। তবে এর হোতাদের এখনও ধরা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুই ছাত্রকে ধরা হয়েছে তারা পুরো জালিয়াতির তৃতীয় স্তরে কাজ করছিলেন। পুরো চক্রটিকে ধরতে সিআইডির একাধিক টিম কাজ করছে।

পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, মূল কাজটি হয় দুই ধাপে। একটি পক্ষ বাইরে থেকে বিশেষ ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়। অপর পক্ষে পরীক্ষার হলে থাকা কিছু শিক্ষার্থী সেই উত্তর জেনে নেন শরীরে লুকিয়ে রাখা বিশেষ ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে।

সিআইডির কর্মকর্তা বলছেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে তাদের ধারণা, কোনো পরীক্ষার্থী পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পরীক্ষা শুরুর পরপরই প্রশ্নপত্র ভাইবার বা হোয়াটঅ্যাপসের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরপর বাইরে একটি চক্র দ্রুত এই প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে আবার বিশেষ ডিভাইসের মাধ্যমে তা পরীক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে তারা মাস্টারকার্ডের মতো দেখতে পাতলা একটি ভিভাইসে সংযুক্ত মোবাইল সিমকার্ড ও ব্লুটুথ ব্যবহার করেন।

পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন, মহিউদ্দিন রানাসহ আরও কয়েকজন 'ক' ইউনিটের পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। এমনকি গত শিক্ষাবর্ষে একই ধরনের জালিয়াতিতে জড়ান এ চক্রের সদস্যরা। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে জনপ্রতি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়। এর বিনিময়ে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ ডিভাইসগুলো। ওই সময় অনেক শিক্ষার্থীর মূল সার্টিফিকেট জব্দ করে রাখেন তারা। শিক্ষার্থী যদি ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তাহলে তার কাছ থেকে বাকি টাকা আদায় করে মূল সার্টিফিকেট ফেরত দেওয়া হয়।

সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঢাবির 'ঘ' ইউনিটের পরীক্ষায় বাইরে থেকে যারা প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিতে সহায়তা করেছেন প্রযুক্তিগত তদন্তে তাদের অনেকের অবস্থান ওই সময় ফার্মগেট ও রংপুরে দেখা গেছে। পুলিশের ধারণা, ফার্মগেটকেন্দ্রিক কোচিং সেন্টার ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল জালিয়াত চক্র। তারা বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, ছাত্রাবাস ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে অর্থের বিনিময়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একই পন্থায় জালিয়াতি চালিয়ে আসছেন। এর সঙ্গে সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসূত্র রয়েছে কি-না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া পরীক্ষার আগেই কোনো চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে কি-না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

সিআইডি জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় যে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের মূল সদস্যদের ধরতে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে। তবে ঘটনার পরপরই রাঘববোয়ালরা গা-ঢাকা দিয়েছে। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কোনো আসামির সর্বোচ্চ দুই বছর সাজার বিধান রয়েছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় শুধু তার ইউনিটে ৫টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এরই মধ্যে একটি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মোবাইল ফোন ও ব্লুটুথে জালিয়াতির ঘটনায় অন্তত আড়াইশ' জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। তবে কোনোভাবে থামানো না যাচ্ছে না জালিয়াত চক্রকে। নিত্য নতুন কৌশল প্রয়োগ করে তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/17101317