২২ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:১৩

আগের অবস্থায় ফেরেনি চালের বাজার

চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিলেও প্রতিশ্রুতি রাখেনি সরকার। একই পথে হাঁটছে মিল মালিকরাও। চালের ঊর্ধ্বমুখী বাজারই এখন স্থিতি অবস্থা। এ নিয়ে সরকার এখন নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। সরকারের এমন নীরবতায় ক্রেতা-ভোক্তার দুর্ভোগ বাড়ছেই। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার বিদেশ থেকে আতপ চাল আমদানি করলেও তার কোন ইতিবাচক প্রভাব নেই। চালের বাজার আগের অবস্থায় ফিরবে কি না কেউ তা বলতে পারছে না।
জানা গেছে, দেশের বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের অভিযান পরিচালনার চাপে চালের দাম এক ধাপ কমিয়ে থেমে গেছেন দেশীয় মিল মালিকেরা। বিক্রেতারা জানান, ২০ সেপ্টেম্বরের দিকে মিল মালিকেরা প্রথম ধাপে চালের দাম বস্তায় দেড়শ টাকার মতো কমিয়েছিলেন। পরের সপ্তাহে কমেছে আরো ২৫ টাকা। এরপর চালের দাম আর কমেনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব বলছে, ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে চালের মজুদ আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। আগের বছর একই সময়ে যা ছিল প্রায় আট লাখ মেট্রিক টন। এসবই আতপ চাল বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সিদ্ধ চালের তুলনায় আতপ চালের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় আমদানি করা চাল বিবর্ণ আকার ধারণ করাসহ নষ্ট হয়ে যেতে পারে- এমন আশঙ্কা করছে খাদ্য অধিদপ্তর। তাই চাল দ্রত বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ফলে বিদেশ থেকে আমদানি করা আতপ চাল নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম দিন রাজধানীতে ১০৯টি ট্রাকে চাল বিক্রি করা হলেও মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি করা ট্রাকের সংখ্যা কমে এসেছে ৩০ এর কোটায়। দিন দিনই কমছে চাল বিক্রির পরিমাণ। গত এক সপ্তাহে সারা দেশে মোট চাল বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪শ ৪৫ টন। এর বেশিরভাগ চালই বিক্রি হয়েছে রাজধানী ঢাকার বাইরে। ঢাকা শহরে বিক্রি হয়েছে খুবই কম।

ডিলাররা বলছেন, ওএমএসের আতপ চালে তাদের লাভ তো দূরের কথা উল্টো ক্ষতি হচ্ছে। তাই চাল সরবরাহ করতে ইচ্ছুক নয় তারা। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে চাল বিক্রি করার জন্য। এই অবস্থায় তারাও পড়ছে বিপাকে।
ধোলাইপাড়ে ওএমএস চাল বিক্রেতা আমজাদ বলেন,সারা দিন চাল নিয়ে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকলেও বৃষ্টি কারণে কেউ চাল নিতে আসেনি। এমনিতেই চাল বিক্রি হয় না তার উপর আবার বৃষ্টি। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। আসলে সরকার নয় চালের ডিলার নিয়ে আমরা মহাবিপাকে পড়েছি। ক্রেতারা চাল ক্রয় না করলে আমাদের কি করার আছে। প্রতিটি দোকানে দেশীয় আতপ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩২ টাকায়। তাহলে কেন আমদানি করা ভাঙ্গা আতপ চাল ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় ক্রয় করবে।
গার্মেন্ট শ্রমিক আলেয়া। মা আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকা। এখানে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন তিনি। মাসে তার আয় ৮ হাজার টাকা। তার মা একটি বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। ওএমএস’র চাল কিনতে এলে তার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান,চাল কিনতে এসে আটা কিনেছি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,বাসায় তো গরু নেই। এই চাল নিয়ে কি করবো। গরুও এ চাল খেতে চায় না। তাহলে আমরা এ চাল নিয়ে কি করবো।
প্রশ্ন হলো সরকার কেন ২শ’ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে এ চাল আমদানি করলো। সরকারের মন্ত্রী বলছেন,খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে। মানুষ কেন খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করবে। মন্ত্রী এমপিরা কি কেউ খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করেছেন। মানুষ কি চাইলেই তার খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে?
যে চালের ভাত খেতে দেশের নাগরিক অভ্যস্ত নয় সে চাল কেন ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করা হলো। এখন সে চাল সংরক্ষণও করা যাচ্ছে না। তাহলে কার স্বার্থে এ চাল আমদানি করা হলো। অথচ সরকার ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলছে চাল আমদানি করলো। এতে বাজার নিয়ন্ত্রন হয়নি,চালের দামও কমেনি।

সম্প্রতি বিদেশ থেকে যে চাল আমদানি করা হচ্ছে তারও বেশিরভাগ আতপ চাল। ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল দেশে এসেছে। এর মধ্যে দুই লাখ টনই আতপ। কম্বোডিয়া থেকে যে আড়াই লাখ টন চাল আসছে সেটাও আতপ। এছাড়া মিয়ানমার থেকে যে চাল আমদানি হবে তাও আতপ।
এদিকে চালের দাম সহনীয় রাখতে গেলো তিন মাসে সরকার প্রায় দুইশো কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দিয়েছে। অথচ এর সুফল পায়নি ভোক্তারা। উল্টো বাড়তি দামেই চাল কিনতে হয়েছে তাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষের জন্য এ সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে তা গেছে মিল মালিক ও আমদানিকারকদের পকেটে। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে, এখনো সরু চাল বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই। কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা কমেছে মোটা চালের দাম।
আগাম বন্যা, হাওরে ফসলহানি এবং সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২০ জুন চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপরও বাজার স্বাভাবিক না হওয়ায় ঠিক একমাস পরই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাকিতে চাল আমদানির সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।এতেও কাজের কাজ কিছু না হলে আগস্ট মাসে ১০ শতাংশ শুল্ক নামিয়ে আনা হয় ২ শতাংশে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, জুন এবং জুলাই এই দুই মাসেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় ১৩৫ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় শুল্ক ছাড়ের ফলে সাময়িক হিসাবে আরো ৬৫ কোটি টাকা রাজস্ব হারায় সরকার। সবমিলে রাজস্ব ক্ষতি প্রায় ২শ কোটি টাকা। কিন্তু বিপরীতে বাজার দাম তো কমেইনি বরং দফায় দফায় তা বেড়েছে। সম্প্রতি মিল মালিকদের সাথে সরকারের বৈঠকের প্রতি কেজিতে এক দুই টাকা কমলেও তা এখনো অস্বাভাবিক বরছেন ক্রেতারা।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমাতে চাল আমদানিতে এই সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে এর সুফল গিয়েছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি পর্যায়ে চালের শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে পণ্যটির দাম কমেছে সামান্য। সরকারের পক্ষ থেকে খোলাবাজারে চাল বিক্রি হলেও দাম তুলনামূলক বেশি। আর তা আতপ চাল হওয়ার কারনে ক্রেতারা কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

এ ছাড়া খোলাবাজারে বিক্রি হওয়া চালের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এতে সরকারের ওএমএস কার্যক্রম চালের দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। চালের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবসায়ীরা চটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিক ব্যাগে পরিবহন, ভ্রাম্যমাণ আদালত থেকে অব্যাহতিসহ বেশকিছু সুযোগ নিয়েছেন। এ প্রতিশ্রুতিও রাখেননি ব্যবসায়ীরা।
একইভাবে সরকারের তিন মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সিদ্ধ চাল আমদানির ফলে বাজার নিয়ন্ত্রন করা হবে। কিন্তু সে চাল গত এক মাসেও আমদানি হয়নি। সরকার যদি চাল আমদানি না-ই করে তাহলে কেন প্রতিশ্রুতি দিলো। মন্ত্রীত্রয় বলেছিলেন,চালের দাম আগের অবস্থায় আসবে। এতে অস্তিরতার কিছু নেই।
এদিকে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণের পরই চালের দাম কমেছে। তবে দাম কিছুটা কমার পর তা স্থির হয়ে গেছে। আর কমছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এটিই যেন চালের স্থিতি অবস্থা। চালের দাম নিয়ে সরকার আর কোন কথা বলছে না। মনে হচ্ছে বাজার সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।
এ বিষয়ে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করছেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম যথেষ্ট কমেছে। এর সঙ্গে সমন্বয় করে খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমাননি। অন্যদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম সামান্য কমেছে। বেশি দাম দিয়ে কিনে এনে খুচরা পর্যায়ে দাম কমানোর সুযোগ নেই বলে তারা জানান।

এদিকে শনিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, এলাকা ভেদে খুচরা বাজারে এখনো মিনিকেট চালের ৫২ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৪০০ টাকায়। আর পাইকারিতে এই চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯০০ টাকায়।
ফলে মিনিকেটের খুচরা মূল্য দাঁড়াচ্ছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, আর পাইকারি মূল্য ৫৮ টাকা। কোরবানির ঈদের পর গুজব ও কারসাজিতে হঠাৎ চলের দাম বেড়ে যায়। আগে এই মিনিকেট বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫২ টাকায়।
বাজারের সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করে দেখা যায়, মিনিকেটর মতোই বিআর আটাশ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। খুচরায় বিআর আটাশ ৫২ কেজির বস্তা ২ হাজার ৬০০ টাকা, আর পাইজাম ২ হাজার ৫০০ টাকা করে।
কাওরান বাজারের সিটি জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী রাসেল জানান, খুচরায় মিনিকেট কেজি প্রতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, নাজিরশাইল ৬৬ থেকে ৬৮ টাকা, ভারতীয় আটাশ চাল ৪৭ টাকা, দেশি আটাশ চাল ৫৪ টাকা এবং ভারতীয় মোটা চাল (স্বর্ণা) ৫৪ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ এক মাসের তথ্যে আরো দেখা যায়, ১২ সেপ্টেম্বর প্রতি কেজি মোটা চাল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর এক মাসের একটু বেশি সময় ধরে ৪৪ থেকে ৫২ টাকার মধ্যেই ওঠানামা করেছে মোটা চালের দাম। প্রায় এক মাস আগে চিকন চাল বিক্রি হয়েছে ৫৬ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে। তা এখন চিকন চাল বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৮ টাকায়। মাসজুড়ে চিকন চালের দামও ওঠানামা করেছে।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের আড়তে মেসার্স লক্ষ্মী ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদ বলেন, আমদানি পর্যায় ও মিলগেট কিংবা পাইকারি পর্যায়ে দাম কমলেও এর প্রভাব খুচরা বাজারে সেভাবে পড়বে না এবং পড়ার তেমন সম্ভাবনাও নেই। কারণ বড় কয়েকটি ছাড়া রাজধানীর বেশিরভাগ কাঁচাবাজার বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। আর বাজারের চেয়ে অলিগলিতে দোকানের সংখ্যা আরো বেশি। যা মনিটরিং করার লোক নেই। মনিটরিং না থাকলে কোনোভাবেই দাম কমানো বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না।এ ছাড়া ভোক্তারাও খুব একটা দরদাম করেন না। বিক্রেতা যে দাম চাচ্ছেন, সেই দামেই নিচ্ছেন ক্রেতারা। তাই দাম কমার সুফল কখনোই সঠিকভাবে ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাবে না বলেও জানান তিনি।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম না কমার জন্য সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, পাইকারিতে চালের দাম কমলেও খুচরায় তেমন কমেনি। কারণ হিসেবে তারা বলেন,বাজারে সরকারের কোন মনিটরিং টিম নেই। আর এ কারনেই পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরায় দাম কমেনি। এর সুফল পাচ্ছে না সাধারন ক্রেতারা। শুধু তাই নয় খুচরা বিক্রেতারা বলছেন দাম আর কমবে না। বাজার এখন স্থিতি রয়েছে। দাম কমাতে কিংবা বাড়াতে আমাদের কোন হাত নেই। আমরা বেশি দামে কিনলে বেশিতে বিক্রি করে থাকি। আর কম দামে কিনলে কমে বিক্রি করে থাকি। আমাদের ওপর দায় চাপিয়ে কোন লাভ নেই।

http://www.dailysangram.com/post/304405