২২ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:১২

টানা বর্ষণে থমকে গেছে রাজধানীসহ সারা দেশের জীবনযাত্রা

দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘মগবাজার-মালিবাগ-শান্তিনগর ফ্লাইওভার’ আগামী ২৬ অক্টোবর উদ্বোধন হওয়ার কথা। প্রকল্পের কাজ চলাকালীন সময়ের মতো কর্তৃপক্ষের ঘোষণা মতে নির্মাণ কাজ শেষেও পথচারিসহ এলাকাবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। টানা বৃষ্টির তৃতীয় দিনে গতকাল শনিবার বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, ফ্লাইওভার এলাকার চৌধুরীপাড়া থেকে মৌচাক মার্কেট পর্যন্ত রাজপথে স্থান ভেদে কয়েক ফুট পর্যন্ত পানি জমে আছে। ফ্লাইওভারের নিচে সড়ক গোঁজামিল দিয়ে পীচঢালা করলেও আগের মতোই কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু রয়ে গেছে। এর আগে দুপুরে দেখা গেলো, রামপুরা বাজার থেকে বনশ্রীগামী ‘পুলিশ ফাঁড়ি রোডটি’ মাঝ বরাবর কাটা। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ‘উন্নয়নে’ আগের তুলনায় মোটা পাইপ বসানোর কাজ চলছে। স্থানীয়রা জানান, বৃষ্টির কয়েকদিন আগে থেকেই কাজ বন্ধ রয়েছে। পানি সরতে না পারায় ভূঁইয়া গলিসহ অলি-গলিতে হাঁটুপানি পর্যন্ত জমে যায়। স্কুলগামী ছেলে-মেয়েসহ কর্মমুখী মানুষের অনেকের পানিতে পড়ে গিয়ে সব ভিজে যায়।

শুধু রামপুরা, মালিবাগ ও মৌচাক এলাকাই নয়, গোটা রাজধানীই এদিন বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায়। এবার বর্ষা মওসুমে চতুর্থবারের মতো ডুবলো ঢাকা। আগের মতো এবারও নগরীর বেশির ভাগ স্থানে হাঁটু পানি, কোথাওবা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি জমে। ভুক্তভোগী নাগরিকসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনমানুষ ও পরিবেশকে উপেক্ষা করে কেবল শ্রেণিস্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে একের পর এক ‘ঠিকাদারবান্ধব’ প্রকল্প নেয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাজধানী শহর ঢাকা। ইতিপূর্বে বহুবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নগর বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিত কাঠামো ও উন্নয়ন, ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপ, খাল-লেকগুলো দখল হয়ে যাওয়া, নি¤œাঞ্চল ভরাট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ঢাকাকে পরিত্যক্ত নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ম্যান্ডেট অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসার পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব থাকলেও সংস্থাটি সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাগযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ নেই।
আবহাওয়া অধিদফতরের সূত্র মতে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপটি এখন পর্যন্ত স্থল নিম্নচাপ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজারে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত বহাল রয়েছে। আর নৌবন্দরগুলোকে ২ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। নি¤œচাপের প্রভাবে গতকাল সারাদেশেই মাঝারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢাকার সদরঘাটের সঙ্গে সারাদেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। সাগর উত্তাল রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ১-২ ফুটের অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশংকার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এছাড়া সড়কে যানবাহন চলাচলও থমকে গিয়ে ভোগান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। অবশ্য আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, নি¤œচাপের প্রভাবে গতকাল সারা দিনই বৃষ্টি হয়েছে। কোথাও থেমে থেমে, কোথাও টানা ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। আজ রোববার সকাল পর্যন্ত চলমান বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর থেকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।

শুক্রবারের মতো গতকালও রাজধানীবাসী সূর্যের মুখ দেখেনি। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকায় ৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া বিভাগ। আর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় ঢাকায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৫৮ মিলিমিটার। ঢাকায় সাধারণত ২৪ ঘন্টায় ৪০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টি হলে পানিবদ্ধতা হয় না। আর এবার টানা বৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে তিন তিনবার। যখনই বৃষ্টি তখনই পানিজট-যানজটে নাকাল হয়েছে নগরবাসী। অন্যদিকে, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সারাদেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়ে পড়েছে। গতকাল বৃষ্টিজনিত কারণে রাজধানীসহ সারাদেশে অন্তত ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ বছর বর্ষার শুরু থেকেই বৃষ্টি রাজধানীর ঢাকাবাসীর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দ্রুত পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানী জুড়ে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পরিচিত এ সমস্যা নগরবাসীর জন্য ফের চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। ডুবন্ত রাস্তায় গণপরিবহন চলাচল করছে অনেক কম। পানিনিমজ্জিত সড়কে রিকসা তো দূরের কথা, পায়ে হেটে চলাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে কার্তিকের টানা বর্ষণে নগরীর বেশিরভাগ এলাকার রাস্তঘাটই ডুবে গেছে। এই অবস্থায় বিপাকে পড়েছেন রাজধানীবাসী। সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় রাস্তা-ঘাটে জনমানুষের আনাগোনা ছিল না বললেই চলে। শ্রমজীবীরা ঘরের বাইরে এসেই দুর্ভোগের মুখে পড়েন। বেসরকারি চাকরিজীবী ও বিশেষ প্রয়োজনে যারা বাসা থেকে বের হয়েছেন তারাই বিড়ম্বনায় পড়েন।

মগবাজার ওয়্যারলেস গেইট থেকে টিএন্ডটি মসজিদ পর্যন্ত সড়কের মতো অনেক স্থানেই রিকসা-ভ্যানওয়ালারা ১০-২০ হাত জায়গা পানি পার করতে জনপ্রতি ৫-১০ টাকা করে নিয়েছে। তবে মতিঝিলসহ কয়েকটি জায়গায় বিনা পয়সায় নৌকায় পারাপারের অভিনব সেবা দিয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার প্রায় সব এলাকায় কমবেশি পানি জমেছে বলে জানা যায়। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণির চলমান গতকালের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

দুপুরে মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনের পানিবদ্ধ এলাকা পারাপারে বিশেষ ‘নৌকা সেবা’ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। সরেজমিনে দেখা গেছে, জাহাজে যেসব লাইফবোট ব্যবহার করা হয় তেমন দুইটি নৌকায় করে সাধারণ মানুষকে পানিমগ্ন এলাকা পারাপারে সহায়তা করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। লাইফবোটগুলোতে একবারে চার-পাঁচজন মানুষ উঠছেন। আর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা রশি দিয়ে সেই বোট টেনে নিয়ে তাদের পানিমগ্ন এলাকা পারাপারের ব্যবস্থা করছেন। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের স্কোয়ার্ডন লিডার ফারুক আহমেদ জানান, টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতার কারণে মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরাই বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। তাই তাদের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিস এই উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি জানান, আজ মতিঝিলের দুইটি এলাকায় এই ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, আরামবাগ এলাকায় নটরডেম কলেজের সামনে একটি ইউনিট এই সেবা দিচ্ছে। আরেকটি ইউনিট সেবা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বসুন্ধরা সিটির পেছনের রাস্তায় কোমরসমান পানি। এখানে পানি পারাপারের জন্য ভ্যান ও রিকশার সহায়তা নিতে দেখা গেছে। পানি পারাপারের জন্য রিকশা ও ভ্যানচালকেরা হাঁকডাক দিচ্ছেন। ১০ টাকার বিনিময়ে পানি পারাপার হচ্ছেন এই এলাকার মানুষ। গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সামনেও একই দৃশ্য। এমনিতেই সেই রাস্তায় রিকশার সংখ্যা কম, এই সুযোগে রিকশাচালকেরা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। বেসরকারি চাকরিজীবী মো. হাসান বলেন, গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সামনে থেকে ফার্মগেট যেতে চাইলে এক রিকশাচালক ১০০ টাকা ভাড়া চান। অথচ এমনি সময় এই ভাড়া ২০ থেকে ২৫ টাকার বেশি নয়।

মিরপুর ১ নম্বর ছাপাখানার মোড় থেকে আনসার ক্যাম্প বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত, মিরপুরের ১১ নম্বর কালশী রোড, কাজীপাড়া, সেনপাড়া, ১৩ নম্বর সেকশন এগুলোর বিভিন্ন সড়কে পানি জমে গেছে। মিরপুর ৬ নম্বরের একাংশ, ১০ নম্বর গোলচত্বরের সড়কের একাংশও পানিতে ডুবে গেছে। শিশুসন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে এক অভিভাবক বলেন, আজ বাচ্চার স্কুলে পরীক্ষা। তাই যেতে হয়েছে। নিজের মোটরসাইকেল থাকায় পরিবহন খোঁজার ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এমনিতেই বৃষ্টি, তার ওপর রাস্তায় পানি জমে থাকায় বেশ অসুবিধা হয়েছে।
খিলগাঁও থেকে সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হন সামিনা রহমান। তিনি বলেন, বাসার সামনে মূল ফটকের সামনেই পানি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো রিকশা পাওয়া গেল না। খোলা নর্দমার কারণে নোংরা পানি পার হয়েই অফিসের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ভাড়াও গুনতে হয়েছে অন্য সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। অফিসে পৌঁছেছেন ভিজে।

ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (পশ্চিম) লিটন বলেন, নগরে তিন দিন ধরে বৃষ্টি। তবে নগরবাসী তেমন বের হচ্ছে না। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় পানি জমেছে, তবে সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় যানজট হয়নি। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন বাইরে বের হচ্ছে না।
এছাড়াও সন্ধ্যা পর্যন্ত নগরীর উত্তরা, কুড়িল, খিলগাঁও, রাজারবাগ, মালিবাগ মোড়, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, ফকিরাপুল, মতিঝিল, কমলাপুর, বাসাবো, গুলিস্তান, পল্টন কালভার্ট রোড, তেজকুনি পাড়া, তেজতুরী বাজার, খিলগাঁও, গোড়ান, বাসাবো, নয়াপল্টন, কাকরাইল, শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজারের ভেতরের দিকে গলি, ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার এলাকার অধিকাংশ সড়কই পানিতে তলিয়ে রয়েছে। একই অবস্থা বাড্ডা, ভাটারা, মেরুল, আফতাবনগর, রামপুরা, নতুন বাজার, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, শেখদী, জুরাইন, শ্যামপুর, রায়শাবাজার, মুগদা, হাজারীবাগ ও সায়েন্সল্যাব, মোহাম্মদপুর এলাকায়।
পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিমউদ্দিন রোড, মতিঝিল, বঙ্গভবনের দক্ষিণ ও পশ্চিমপাশের সড়ক, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে বেশি পানি জমেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। সড়কের ম্যানহোল এবং নিষ্কাশন নালার পিটগুলো খুলে দেয়ার কাজ করছে সিটি করপোরেশন। এ কাজে ডিএসসিসির ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ মাঠে রয়েছে বলে জানান ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ময়লা জমে ড্রেনের অনেক জায়গায় ব্লক হয়েছে। সেগুলো আমরা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। চারদিকে আমাদের লোক নেমেছে। রাতেও তারা কাজ করেছে। সবখানেই পানি আছে। তবে আশার কথা হলো পানি যাচ্ছে। কোথাও স্লো, কোথাও ফাস্ট।
টানা বৃষ্টির কারণে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বড় এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে রাজধানীতে। সকালে গাবতলীতে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক যাত্রী বাসের অপেক্ষা করছেন। কয়েকটি বাসের কাউন্টারে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া যানজটের কারণে বাস সময়মতো কাউন্টারে এসে পৌঁছায়নি। রাজশাহীগামী ন্যাশনাল বাস কাউন্টারে বসে ছিলেন ফজলে রাব্বী। তিনি জানান, বেলা একটার বাসের জন্য তিনি এসে দেখেন বাস আসেনি। কাউন্টার থেকেও সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার (গাবতলী) সাইফুল আলম বলেন, গাবতলী থেকে দক্ষিণবঙ্গের যেসব বাস আছে, সেগুলো ছাড়ছে না। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ফেরি বন্ধ রয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে শুক্রবার ভোর থেকে সৃষ্ট যানজট গতকাল সকালেও রয়েছে। মহাসড়কের গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে মির্জাপুরের সোহাগপুর পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় এবং টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে করটিয়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার যানজট। চন্দ্রা থেকে নবীনগর সড়কের আট কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট রয়েছে। চন্দ্রা থেকে গাজীপুর রাস্তাতেও তিন কিলোমিটার পর্যন্ত যানজট।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও গাজীপুরের চন্দ্রা থেকে কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের বিভিন্ন জায়গায় এমনিতেই গর্ত। বৃষ্টিতে এসব গর্তে জমেছে পানি। একই সঙ্গে চলছে চার লেন তৈরির খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। এতে শুক্রবার ভোররাত থেকে শুরু হয় যানজট। রাস্তা পার হতে সময় লাগছে দ্বিগুণেরও বেশি। কোনাবাড়ী হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হোসেন সরকার জানান, বৃষ্টির কারণে রাস্তার খানাখন্দে পানি জমেছে। এতে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। এ কারণে যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সারা দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়মিত চলাচলকারী বিমান চলাচল ব্যাহত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ অনেকগুলো গন্তব্যে বিমান যে সময় ছাড়ার কথা, তা ছাড়েনি। একজন যাত্রী জানান, বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ শুক্রবার ৪টা ৫০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ছেড়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে। পরে গতকাল সকাল সাড়ে নয়টায় ছাড়ার কথা থাকলেও বিমান ছেড়েছে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ফেনীতে ৩০৬ মিলিমিটার। একই সময়ে গোপালগঞ্জে ১৭৮ মিলিমিটার, টাঙ্গাইলে ২০৬, মাদারীপুরে ১৩২, ফরিদপুরে ১২২, কুমিল্লা ১৮৬, নোয়াখালীর মাইজদীকোর্টে ১২৬, হাতিয়ায় ১৮৮, চাঁদপুরে ১৪৩, বরিশালে ১৪১, পটুয়াখালীতে ১২৪, খেপুপাড়ায় ১০৯, ভোলায় ৭৯, যশোরে ১০০, কুমারখালীতে ৯৬, খুলনায় ৯৬, ঈশ্বরদী ১৩৫, তাড়াশ ১২৫, বগুড়া ১১৮, চট্টগ্রাম ৩৪ ও সন্দ্বীপে ১৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ঢাকার পানি সরে না কেন : বছরের পর বছর কথা হলেও রাজধানী ঢাকার পানিবদ্ধতা সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পানির নিচে চলে যায় সব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই। তাহলে পানিবদ্ধতা হবে না কেন? তারা বলছেন, খাল-লেক দখলের মতো পুরনো বিষয়গুলোর সাথে অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার বা স্যুয়ারেজ ড্রেনের কাজ করায় বৃষ্টির পানি জমে থাকছে সহজে।

সাম্্রপতিক সময়ে বর্ষণে ঢাকা বলতে গেলে পুরোটাই ডুবে যায়। পানিজট এবং যানজটে নগরী বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে। সেই পানি এখন নেমে গেলেও রাজধানীর অনেক এলাকা, বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল বেশ কিছুদিন পানিতে ডুবে থাকে। সেসব অঞ্চলে ঈদ কেটেছে হাঁটু পানিতে। কেউ কেউ বাসায় থাকতে না পেরে বাসা পরিবর্তন করছেন। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা এসব বাড়ি বা বস্তিতে থাকেন, তারা চাইলেই বেশি ভাড়ায় নতুন বাড়িতে উঠতে পারেন না। ফলে অনেককেই পানিবদ্ধতার সঙ্গেই বসবাস করতে হয়।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে। গত চার বছরে ৩০৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নতি সাধনে। বৃষ্টিপাত থেকে যে পানি জমা হয়, তা ‘রানঅফ ওয়াটার’ বলে পরিচিত। রাজধানীর এই পানি ‘স্টর্ম' ড্রেন দিয়ে নিষ্কাশিত হওয়ার কথা। গতবছর থেকে ঢাকা ওয়াসা ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু তা কবে শেষ হবে নিশ্চিত নয়।
ঢাকা ওয়াসার একটা প্রধান দায়িত্ব হলো, পানি সরবরাহ এবং শহরের ৩৯% ড্রেনেজ সিস্টেমকে সচল রাখা। তা করার জন্য ৬৫ কিলোমিটার খোলাখাল এবং ও বক্সকালভার্ট আছে। এছাড়াও এদের আছে ড্রেনেজ পাম্পিং সিস্টেম। কিন্তু অসময়ে কিছুই কাজে আসে না।

অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরীতে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করছেন। এই শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে শহরের বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ছয় হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকার প্রত্যেক নাগরিক ৩৭৭ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে, যার ৯৭ শতাংশই জৈব পদার্থ। বাকি ৩ শতাংশ বর্জ্য অজৈব। গত ১০ বছরে এ মহানগরীতে বর্জ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১০ বছর আগে দৈনিক তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ হারে অপসারিত হতো এক হাজার ৩৭৬ টন। এখন দৈনিক ছয় হাজার ১১০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে অপসারিত হয় চার হাজার ৫৮২ টন। এইসব বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ছাড়াও কঠিন বর্জ্য সরাসরি ডাম্পিংয়ে নেয়া হয়। তবে বৃষ্টিতে পানি জমলে কঠিন এবং তরল বর্জ্য একাকার হয়ে যায়।

পানিবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দু'টি অত্যাধুনিক 'জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন' কিনেছে। বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না।
রাজধানীর এই পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসারও। কিন্তু এ নিয়ে ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আছে রশি টানাটানি। ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেয়া হয়। পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা। ওয়াসা ২০১৪ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, পানিবদ্ধতার দায় ওয়াসা নেবে না। কারণ, পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হলেও ওয়াসার চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইনের সংখ্যা বেশি। বার্ষিক ক্লিনিংয়ের ব্যাপারেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। এজন্য সামান্য বৃষ্টিতেই পানিজট দেখা দেয়।
বিআইডব্লিউটিএ'র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং নগর বিষেশজ্ঞ তোফায়েল আহম্মেদ বলেন, পানির ধর্মকে অস্বীকার করে আমরা ঢাকা শহর থেকে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছি। ঢাকার মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি। ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না। পানি নীচের দিকে যায়। যেতে না পেরে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঢাকার প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ করে অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই পানিবদ্ধতা দূর করা কঠিন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইন্সটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, “আশির দশকে নগর বন্যার পর ফ্লাড অ্যাকশন প্রোগ্রাম (ফ্যাপ)-এর আওতায় ঢাকার চারপাশ ঘিরে একাংশে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি হয়। কিন্তু পুরো কাজ আর হয়নি। কথা ছিল ওটা হলে সার্কুলার রোড, ড্রেন এসব তৈরি হবে। কিন্তু হয়নি। আর ঢাকার চারপাশে নদী। থাইল্যান্ডে শহরের ভিতরে ওয়াটার বোট চলে। আমাদেরও সুযোগ ছিল। কিন্তু আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। শহরের নদী- খাল ভরাট করে আমরা রাস্তা বানিয়েছি। ফলে এখন পানিবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট সিস্টেম এরইমধ্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। শুনেছি, এগুলো নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে। পাম্পের মাধ্যমে বিপুল পানি নিষ্কাশনের চিন্তা সঠিক নয়। কারণ, এটা বিশাল খরচের ব্যাপার। তাই ঢাকা শহরের পানিবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার আগে ভাবতে হবে। এই অধ্যাপক বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই পানি নিষ্কাশনের পথগুলো খুলে দেয়া হলো সহজ পথ।

http://www.dailysangram.com/post/304404