২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:২৭

আয় বৈষম্য বাড়ায় চাপে মধ্যবিত্ত

একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জাফর আহমেদ। বয়স ৪৪ বছর। রাজধানীর হাতিরপুলে মেসে থাকেন। প্রতি মাসে আয় ২০ হাজার টাকার ওপরে। তিনি জানান, এখান থেকে বাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় হচ্ছে বেতনের অর্ধেক টাকা। প্রতি মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করতে যায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।
এরপর দুই মেয়ে ইয়াসমিন এবং নিশির লেখা পড়া বাবদ খরচ ৩ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতিদিন কিছু টুকটাক খরচ থাকে। সব মিলিয়ে এখন তার কোনো সঞ্চয় থাকে না। অথচ গত বছরের একই সময়ে প্রতি মাসেই নিরাপত্তার জন্য তার কিছু টাকা জমা থাকতো। তিনি বলেন, এসবের মাঝে বড় কোনো অসুখ হলে ঋণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এছাড়া সহজে ডাক্তারের কাছে যান না জাফর। অন্যদিকে বড় মেয়ের বিয়ে দেয়ার চিন্তা তো আছেই।

রাজধানীর একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন মো. আরিফ হোসেন। মাস শেষে বেতন-ভাতা সবকিছু মিলিয়ে যা পান এর বাইরে তার বাড়তি আয়ের আর কোনো সুযোগ নেই। এ টাকা দিয়েই চার সদস্যের পরিবারের সংসার খরচ চালাতে হয় আরিফকে। চাল, সবজিসহ নিত্যপণ্যের যে দাম তাতে প্রতি মাসেই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। আর সাম্প্রতিক সময়ে চাল, সবজির লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখিতায় অনেকটাই নুন আনতে পান্থা ফুরায় অবস্থা আরিফের। তিনি জানান, উত্তরখানের একটি টিনশেডের বাড়িতে দুই রুম ভাড়া নিয়ে থাকেন। প্রতি মাসে বাসা ভাড়া দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। চাল কিনতে লাগে ২ হাজার টাকার ওপরে। ছেলে ও মেয়ের লেখাপড়ার পেছনে খরচ হয় ১ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়েই তাকে মেটাতে হয় সারা মাসের বাজারসহ অন্য খরচ। ফলে সকাল-সন্ধ্যা অফিস করে যে টাকা পান তা দিয়ে ভালো মতো সংসার চালানোই দুষ্কর। এ পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়ে কোনো অবদার করলে অধিকাংশই তা পূরণ করা সম্ভব হয় না। এই শিক্ষক বলেন, আমার ছেলে ক্লাস থ্রিতে এবং মেয়ে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা প্রায় বিভিন্ন বায়না ধরে। ভালো খাবার খেতে চায়। ওরা তো আর বোঝে না আমার সামর্থ্য। কিছুদিন আগে ছেলে-মেয়ে দু’জনই বায়না ধরলো শিশু পার্কে ঘুরতে যাওয়ার। ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্যে না কুলানোর কারণে তাদের সেই আবদার রাখতে পারিনি। অনেক বুঝিয়ে তাদের শান্ত করি।

আরিফ বলেন, যে বেতন পাই তা দিয়ে এমনিই টানাটানি করে সংসার চলে। এ পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক চাল ও সবজির যে দাম বেড়েছে তাতে সংসার চালানো বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। দুপুরে ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বেশি ক্ষুধা লাগলে মাঝে মধ্যে দোকান থেকে রুটি কিনে পানি দিয়ে ভিজিয়ে খাই। দুপুরে ভাত খাই না এ কথা বাসায় কখনো বলিনি। কিন্তু অফিস শেষে মলিন মুখে বাসায় ফিরলে স্ত্রী বুঝে যায় দুপুরে কিছু খাইনি। আমারও ধারণা দুপুরে ছেলে-মেয়ের মুখে কিছু খাবার তুলে দিলেও স্ত্রীও প্রায় সময় না খেয়ে থাকে।

শুধু জাফর, আরিফ নয় রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশেরই জীবনযাত্রার চিত্র এটি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার নিচে থাকা রাজধানীবাসীর অধিকাংশই এখন ভালো নেই। ঢাকাতে বড় অংশেরই আয় ২০ হাজার টাকার নিচে। শুধু ঢাকা শহরে একটি অংশ নয়, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে দেশের অসংখ্য মানুষের।
বর্তমানে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে ৩ লাখের ওপর শ্রমিক রয়েছেন যারা ন্যূনতম মজুরিভুক্ত। যাদের বেতন ১০ হাজার টাকার নিচে। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। মোটা চালের কেজি ৪২ থেকে ৫০ টাকা। খোলা আটার কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা। পাশাপাশি কাঁচা সবজির দামও বেশ চড়া। রাজধানীর বাজারগুলোতে ৬০ টাকা কেজি দরের নিচে কোনো সবজি পাওয়া এখন দুরূহ।

আরেক স্কুল শিক্ষিকা লায়লা বানু বলেন, তার স্বামী একজন বীমা কর্মী। দুজনের আয়ে ঢাকা শহরে এক ননদ ও এক ছেলে নিয়ে চারজনের সংসার তাদের। লায়লা বলেন, আমরা দু’জনে যে আয় করি তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। ননদ হাইস্কুলে পড়ে। ছেলে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। সংসারের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে মাস শেষে কোনো টাকা উদ্বৃত্ত থাকে না। যা আয় হয় তার সবই সংসার চালাতে ব্যয় হয়ে যায়। হিসাব করে খরচ করেও গত মাসে এক কলিগের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করতে হয়েছে। বর্তমানে দ্রব্য মূল্যের যে দাম তা অব্যাহত থাকলে হয় তো সামনে একবেলা খাওয়া বন্ধই করে দিতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজিব উদ্দিন সিদ্দিক বলেন, আমরা অল্প আয়ের মানুষ। মাসে যে টাকা বেতন পাই খরচ তার চেয়ে অনেক বেশি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, বাসাভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে গতিতে বাড়ছে সে তুলনায় আমাদের আয় তো বাড়ছে না। চাল আর কাঁচাবাজার কিনতেই আয়ের বেশিরভাগ টাকা চলে যায়। তিনি বলেন, খাওয়া তো আর বন্ধ থাকে না। তাই সংসারের অন্যদিকে খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছি। তার মতে, মধ্যবিত্তদের টিকে থাকা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভ্যানচালক আফজাল বলেন, আগে চালের সঙ্গে ডিম, মাছ, সবজি কিনতাম। এখন আর মাছ, ডিম কেনা হয় না। কারণ চাল আর কাঁচাবাজার সব খেয়ে ফেলছে। কারণ ভাত আর সবজির ওপরই আমরা নির্ভরশীল। কষ্টের কাজ করি। দিনে তিনবেলা ভাত খেতে হয়। কিন্তু চাল আর কাঁচাবাজারের দাম যেভাবে বাড়ছে এখন আর তিনবেলা খাওয়া দুষ্কর। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাবো? এমনিতেই অল্প আয় দিয়ে আমাদের পরিবার চলে। তার ওপর যদি নিত্যপণ্যের দাম এতো বাড়ে আমরা বাঁচবো কিভাবে?

বেসরকারি চাকরিজীবী ইমদাদুল হক। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশ ভালো বেতনেই চাকরি করেন তিনি। তারপরও শান্তি নেই বলে জানান তিনি। বলেন, বাসা ভাড়া এবং বাচ্চাদের স্কুলের বেতন, প্রাইভেট টিউটরের সম্মানীসহ পড়াশোনার খরচেই চলে যায় বেশির ভাগ টাকা। সেসব খরচ জোগাতে গিয়ে টান পড়ছে তার কাঁচাবাজারের বাজেটে। তিনি জানালেন, কাঁচাবাজারেও যেন সব কিছুর দামই লাগামহীন পাগলা ঘোড়া। মাছের দাম বেড়েছে। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির একটা পর্যায়ে থমকে থাকায়, চাল নিয়ে আতঙ্ক কিছুটা কম থাকলেও, কোনো সবজির দামই ৬০ টাকার নিচে কেজি নেই। মরিচের দামেও ঊর্ধ্বগতি। তার প্রশ্ন এভাবে আর কতদিন চলা যাবে?

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও বেড়েছে বৈষম্যের হার। গত ৬ বছরে সার্বিক দারিদ্র্যের হার সাড়ে ৩১.৫ শতাংশ থেকে কমে ২৪.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১.৫ শতাংশ। অন্যদিকে বৈষম্যের হার বেড়েছে। অর্থাৎ ধনী ব্যক্তির আয়ের হার যে হারে বেড়েছে, গরিব মানুষের আয়ের হার সে তুলনায় বাড়েনি। বিবিএস সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী। আর মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ।
ওদিকে বিবিএস তথ্যমতে, দেশে পণ্য সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয়ভাবে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬.১২ শতাংশ। তবে গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছে এর চেয়ে বেশি হারে। গ্রামের হার ৬.২১ শতাংশ, যা শহরের চেয়ে অনেক বেশি। সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ২৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এ হার ছিল ৬.১৯ শতাংশ।

এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালে খানা আয়-ব্যয় জরিপ করা হয়। আর ২ হাজার ৩০৪টি নমুনা এলাকার ৪৬ হাজার ৮০টি খানার তথ্যের ভিত্তিতে খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ সম্পন্ন করেছে বিবিএস।
খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে খানার মাসিক আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫,৯৪৫ টাকা। ২০১০ সালে এ আয় ছিল ১১,৪৭৯ টাকা। শহরে প্রতি খানায় মাসিক আয় এখন ২২,৫৬৫ টাকা, ২০১০ সালে যা ছিল ১৬,৪৭৫ টাকা। আর গ্রামে মাসিক আয় ৯,৬৪৮ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩,৩৫৩ টাকায়।
বিবিএস বলছে, দেশের সব মানুষের যত আয়, এর মাত্র ১.০১ শতাংশ আয় করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। ৬ বছর আগেও মোট আয়ের ২ শতাংশ এই শ্রেণির মানুষের দখলে ছিল। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের ৩৮.১৬ শতাংশ। ৬ বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩৫.৮৪ শতাংশ। বিবিএস জরিপে বলা হয়, দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক ওপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে দারিদ্র্য কমেছে এটা একটা ভালো সংবাদ। এই দারিদ্র্য কমার সূচকে হতদারিদ্র্য রয়েছে। কিন্তু এই জরিপে কিছু মন্দ দিক উঠে এসেছে। এর একটি হলো আয় বৈষম্য বেড়েছে। এর মানে হলো দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু সেটা দরিদ্র বান্ধব প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। মানুষের কর্মসংস্থান বান্ধব প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। জাহিদ হোসেন বলেন, কৃষির অবদান কমে গেছে। উৎপাদন খাতে যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার সুফল ভোগ করছেন উৎপাদনমুখী শিল্পের মালিকরা।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=88467