২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:১৫

উৎপাদন খরচ কমালে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট এক টাকা ৩২ পয়সা কমানো সম্ভব

বিদ্যুৎ উৎপাদনের লুটপাট বন্ধ করতে পারলে এবং খরচ সমন্বয় করলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা । তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয় বরং প্রতি ইউনিট এক টাকা ৩২ পয়সা কমানো সম্ভব। বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব)এর প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গত ৫ অক্টোবর গুশুনানি করেছে।

ক্যাব বলছে, কম খরচে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এজন্য ভোক্তারা বছরে সাত হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
ক্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, খরচগুলো সমন্বয় করা হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম ৬ পয়সা কমানো সম্ভব। আর উৎপাদন খরচ কমালে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১ টাকা ৩২ পয়সা পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম তার প্রস্তাবনায় দেখান, পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাবে রাজস্ব চাহিদায় প্রতি ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ঘাটতি ৫ পয়সা। এ ছাড়া দরপতন সমন্বয়কৃত মূল্যহারে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারের ঘাটতি ১৪ পয়সা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় ৮ পয়সা এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় ৪ পয়সা। সবমিলিয়ে এই ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত দামহার বৃদ্ধির সঙ্গেও যদি সমন্বয় করা হয় তবে বার্ষিক ৩২১ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। ফলে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বাড়ানো নয়, ৬ পয়সা কমানো যায়।
তিনি বলেন, সরকার কমদক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবির বিদ্যৎ কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিদ্যুৎ উপাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে সরকার। এই দুর্নীতি বন্ধ এবং নীতিগত ভুল সংশোধন করতে হবে।

পাইকারি বিদ্যুতের দামহারে ২ বছরে ৪ ধাপে উদ্বৃত্ত ১ টাকা ৩২ পয়সা সমন্বয় করে বর্তমান দাম ৪ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমিয়ে ৩ টাকা ৫৮ পয়সা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নীতিগত ভুলের মাশুল বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে দিতে হচ্ছে জনগণকে। অন্যায্যভাবে উৎ্পাদন খরচ বাড়িয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো অন্যায় ও অযৌক্তিক।
শামসুল আলম বিদ্যুৎ খাতের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে বলেন, বিনা দরপত্রে অমীমাংসিতভাবে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে সেগুলোতে কারিগরি ও আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে। এগুলো নির্মাণে যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে প্রকৃত ব্যয় তার চেয়েও অন্তত অর্ধেক কম।
সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ব্যবহার ৫০১৯ কোটি ৩২ লাখ ইউনিট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫৩৯১ কোটি ৫০ লাখ ইউনিট। বর্তমানে পাইকারি বিদ্যুতের দাম হার ভারিত গড়ে চার টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু পাঁচ পয়সা ঘাটতিতে সে মূল্যহার চার টাকা ৮৫ পয়সা ধরে ৭২ পয়সা রাজস্ব ঘাটতি পূরণে দামবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়হার কমানোর কোনো কৌশল গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পাইকারি বিদ্যুত আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। সে ঘাটতি সমন্বয়ের অজুহাতে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।

সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ কর-ভ্যাটের মাধ্যমে সরকারকে টাকা দিচ্ছে। তা থেকে এ খাতে বরাদ্দ দিতে হবে, ভর্তুকি নয়।
কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মাকসুদ বলেন, সরকার অনেক সময় খেয়াল-খুশি মতো কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়ানোতে সহযোগিতা করে কিংবা নিজেই বাড়িয়ে দেয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের বোঝা কমাবে কিন্তু বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। সরকার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, তারা বলতে পারে না এক্ষেত্রে লাভ কিংবা লোকসান হচ্ছে। সংবেদনশীলতার সঙ্গে যাচাই না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা হবে জনগণকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার শামিল।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ্ একটি কৌশলগত পণ্য এবং এটির দাম বেড়ে গেলে অন্য সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। একটি মুদ্রাস্ফীতি, এতে জনগণের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং অন্যটি দেশের পণ্যের উৎ্পাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে রপ্তানিখাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায়। তাই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব হলে তা কমানো দরকার।

বিদ্যুতের দাম হার কমানোর যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের দাম হারে ঘাটতি পাঁচ পয়সা, দরপতন সমন্বয়কৃত দাম হারে ফার্নেস অয়েল পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারে ঘাটতি ১৪ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে এটা না বাড়িয়ে কমানো সম্ভব। অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ভোক্তাপর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় আট পয়সা ও পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় চার পয়সা। সর্বমোট এ ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত দামহার বৃদ্ধিতে সমন্বয় হলে উদ্বৃত্ত হয় ৩২১ কোটি টাকা। তাতে দামহার ৭২ পয়সা বাড়ানো নয়, ছয় পয়সা কমানো যায়।

এদিকে যদিও গ্যাসে মেঘনাঘাট আইপিপিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো তাহলে ব্যয় সাশ্রয় হতো এক হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। গ্যাসভিত্তিক ভাড়া-দ্রুত ভাড়া বিদ্যুৎ তিন টাকা ৩৭ পয়সা দাম হারে কেনার পরিবর্তে ওই গ্যাসে সরকারি খাত উৎপাদন ক্ষমতায় শুধু ৮৬ পয়সা জ্বালানি ব্যয় হারে ওই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। ব্যয় সাশ্রয় হতো এক হাজার ৩০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির দরপতন সমন্বয় সমতা নিশ্চিত হলে ব্যয় সাশ্রয় হতো দুই হাজার ১১২ কোটি টাকা। বেশি দামি ডিজেল বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করার কৌশল গৃহীত হলে সাশ্রয় হতো ৭৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভাড়া-দ্রুত ভাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট যৌক্তিক হলে নন-ফুয়েল ব্যয় হার অনুসরণে সাশ্রয় হতো ৮৫৫ কোটি ৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয় হতো কমপক্ষে ছয় হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যয়হার হ্রাস পেত এক টাকা ২৬ পয়সা। সব মিলিয়ে এক টাকা ৩২ পয়সা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব।

http://www.dailysangram.com/post/304289