২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:১১

মিয়ানমারের মিথ্যাচার

আত্মপক্ষ

এবনে গোলাম সামাদ
মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, রোহিঙ্গারা হলো ব্রিটিশ শাসনামলের এবং তার পরে আরাকানে যাওয়া বাংলাভাষী মুসলমান। তারা আরাকানের আদি বাসিন্দা নয়; কিন্তু তাদের এই বক্তব্যকে সত্য বলে মেনে নেয়া যায় না। কেননা, আরাকানের রাজা মেং সোআমউন দক্ষিণ বর্মার এক রাজার কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ (৮২১-৩৬ হিজরি, অর্থাৎ ১৪১৮-৩৩ খ্রি.)-এর কাছে। জালালুদ্দীন তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন তার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য। মেং সোআমউন তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের পর গৌড় থেকে নিয়ে যাওয়া সৈন্যদের রেখে দেন তার রাজ্যের নতুন রাজধানী রোহং শহরে। গৌড় থেকে নিয়ে যাওয়া মুসলমান সৈন্যদের বংশধরদের বলা হতে থাকে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাই ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানে গিয়ে বসতি করেছে এমন নয়। মেং সোআমউনের সময় থেকে একটি বিশেষ ঘটনার কথা অনেক ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। তা হলোÑ আরাকানের রাজারা দু’টি করে নাম গ্রহণ করতেন। একটি হলো আরাকানি ভাষার নাম, আর অপরটি হলো গৌড়ের সুলতানদের অনুকরণে আরবি-ফারসি ধারার মুসলমানি নাম। এসব রাজার বেশ কিছুসংখ্যক মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এসব মুদ্রা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এই দ্বৈত নামের। এ রকম কিছু মুদ্রা সংরক্ষিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। মুদ্রার একপিঠে আরবি-ফারসি অক্ষরে লেখা থাকতে দেখা যায় তাদের মুসলিম নাম। এমনকি এদের মধ্যে তিনজন রাজার মুদ্রার ওপর কালেমায়ে তাইয়িবা লেখা থাকতে দেখা যায়। জালালুদ্দীনের ছিল বিশাল সাম্রাজ্য, যার বিস্তার ছিল দক্ষিণ বিহার, ত্রিপুরাসহ সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশ বলতে বুঝিয়েছে আরাকান সীমান্ত পর্যন্ত। আরাকানের আকিয়াব (বর্তমান নাম সিৎওয়ে) বন্দরনগরীতে আছে একটি গৌড়ীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরী বিরাট মসজিদ (শুনেছি এখন সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে)। এই মসজিদ থেকেও প্রমাণিত হয়, আরাকানে সুলতানি আমলে গৌড় থেকে মুসলমানদের যাওয়ার কথা। তাই কেবল ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে আরাকানে বাংলাভাষী মুসলমানরা গিয়েছেন, এ কথা দাবি করা চলে না।

মুদ্রা ও মসজিদ স্থাপত্য প্রমাণ করে, আরাকানের ওপর সুলতানি আমলের বাংলার প্রভাব। এ ছাড়া আরাকানের রাজসভায় রাজারা করেছেন বাংলাভাষা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা। সেখানে স্থান পেয়েছেন দৌলত কাজী ও আলাওলের মতো কবি। আরাকানের ইতিহাস আর মিয়ানমারের মূল ভূভাগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা নয়। আরাকান মিয়ানমারের অংশ হয়েছে ব্রিটিশ শাসনামলে। এর আগে তা ছিল একটি পৃথক রাজ্য। আর এই রাজ্যের সাথে ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। বার্মার মূল ভূ-ভাগের সংস্কৃতির সাথে আরাকানের যোগাযোগ কখনোই সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। আরাকানে যে বর্মি ভাষা চলে, সেটা প্রাচীন বর্মি ভাষার একটি উপভাষা। এ রকমই বলেন বেশির ভাগ ভাষাতাত্ত্বিক। কেননা, আধুনিক বর্মি (ম্রনমা) ভাষীরা সেটা বুঝে উঠতে পারে না। অথচ উত্তর ও পূর্ব আরাকানে চলে চট্টগ্রামের কথিত বাংলা ভাষা। আর বৌদ্ধ আরাকানিরাও হাটবাজারে এই ভাষা বলে এবং বোঝে।

বর্তমান মিয়ানমার হলো ব্রিটিশ শাসনের ফল। দক্ষিণ বর্মার রাজা বোদপায়া আরাকান জয় করেন ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে, মনিপুর জয় করেন ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং সাবেক আসাম জয় করেন ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম বার্মা যুদ্ধ হয় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টের (Amherst) সময়, ১৮২৪-১৮২৬ খ্রি.। আমহার্স্ট আসাম, আরাকান ও টেনাসেরিন জয় করেন। দ্বিতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ হয় ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডাল হৌসির সময়, ১৮৫২ খ্রি.। ডাল হৌসি পেগু (Pegu) অধিকার করেন। তৃতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ হয় ভাইসরয় ডাফরিনের (Dufferin) সময়, ১৮৮৫ খ্রি.। এর ফলে উত্তর বার্মা এসে যায় ব্রিটিশ শাসনে। ব্রিটেন আসামকে বার্মার সাথে যোগ করেনি; করেছে ভারতের সাথে। তাই আসাম হয়েছে বর্তমান ভারতের অংশ, যা এখন আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং মনিপুরে বিভক্ত। মনিপুরকে অবশ্য ব্রিটিশ সরকার শুরুতেই একটা করদমিত্র রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল; কিন্তু ব্রিটিশ রাজ আরাকানকে যুক্ত করে বার্মার (মিয়ানমার) সাথে। আরাকান তাই এখন হতে পেরেছে মিয়ানমারের অঙ্গরাষ্ট্র। নইলে হতো না। আরাকানে বাংলাদেশ থেকে বাংলাভাষী মুসলমান যদি কেবল ব্রিটিশ আমলেই যেয়ে থাকে, তবে সেটাকেও কম দিনের ঘটনা বলা যায় না। এই সময় যেসব বাংলাভাষী মুসলমান আরাকানে গিয়েছে, তাদের সন্তান-সন্ততিকে আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে ধরতে হয় জন্মসূত্রে আরাকানেরই নাগরিক। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়ার অধিকার মিয়ানমার সরকারের নেই।

মানুষ কেবল বাংলাদেশ থেকে আরাকানে যায়নি। আরাকান থেকেও বহু মানুষ এসেছে বাংলাদেশে। বোদপায়া ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন আরাকান দখল করেন, তখন চাকমা ও মারমাদের পূর্বপুরুষ আসে বাংলাদেশে পালিয়ে। চাকমা ও মারমাদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়নে কোনো উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেনি এবং করবেও না। সে এ ক্ষেত্রে সাধারণ আন্তর্জাতিক প্রথাকেই অনুসরণ করতে ইচ্ছুক। এ কারণে সে মারমাদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানে মারমা ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। চাকমাদের কোনো নিজস্ব ভাষা এখন আর নেই। তাই বাংলা ভাষাতেই হচ্ছে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা। অর্থাৎ বাংলা ভাষাতেই তারা শিখছে পড়তে, লিখতে ও গুনতে। কেবল তাই নয়, চাকমা কবিরা বাংলা ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন এবং লিখছেন।
এখানে উল্লেখ করা উচিত হবে, ব্রিটিশ সরকার প্রথমে গোটা বার্মাকে ভারত সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে। বার্মা একসময় ছিল ব্রিটিশ-ভারত সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ প্রদেশ। এ সময় ভারতের মূল ভূভাগ থেকে সমুদ্রপথে প্রায় ১০ লাখ ভারতীয় যায় বার্মায় প্রধানত ব্যবসায় ও চাকরি করতে। কিন্তু আরাকানে বাংলাদেশ থেকে মানুষ গিয়েছে স্থলপথে। আরাকান থেকে মানুষ বাংলাদেশে এসেছে স্থলপথে। ব্রিটিশ শাসনামলে গ্রেটব্রিটেন ১৯৩৭ সালে ১ এপিলে বর্মাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি পৃথক দেশে পরিণত করে এবং কিছু স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। ভারত থেকে বার্মায় মানুষ যাওয়া খুবই সীমিত হয়ে পড়ে। ১৯৪১ সালের শেষভাগে জাপান সমুদ্রপথে এসে বার্মা আক্রমণ করে এবং ১৯৪২ সালের মধ্যে গোটা বার্মা দখল করে নেয়। ১৯৪২ সালে জাপান রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) থেকে স্পিডবোটে করে এসে আরাকান দখল করে নেয়। জাপান যখন বার্মা দখল করতে থাকে, সে সময় বর্মীরা ভারতীয়দের আক্রমণ করে বিতাড়ন শুরু করে। এ সময় দলে দলে ভারতীয়রা পালিয়ে আসতে থাকে ভারতে। বহু ভারতীয় অনাহারে এবং বর্মিদের আক্রমণে প্রাণ হারায় পালিয়ে আসার পথে। কিন্তু জাপান আরাকান অধিকার করার সময় এভাবে আরাকান থেকে বাংলাভাষীদের পালিয়ে আসতে হয়নি বাংলাদেশে; কিন্তু এখন পালিয়ে আসতে হচ্ছে বৌদ্ধবাদী ম্রনমা সেনাদের পৈশাচিক আক্রমণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, তিনি যুদ্ধ চান না; চান আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। অন্য দিকে তার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছেন, মিয়ানমার একটি ব্লাডি কান্ট্রি। সে যা করছে সেটা বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। অর্থাৎ বর্তমান কেবিনেটে সৃষ্টি হয়েছে গুরুতর মতপার্থক্য। কেবিনেটের সব সদস্যই ভাবতে পারছেন না যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে কেবল আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে।

ক’দিন আগে আমরা দেখলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউনেস্কো থেকে বেরিয়ে গেল। হয়তো আগামীতে সে জাতিসঙ্ঘ থেকেই বেরিয়ে যাবে। ফলে জাতিসঙ্ঘের অবস্থা দাঁড়াবে লিগ অব নেশন্স বা জাতিপুঞ্জের মতো। আলোচনার মাধ্যমে এ যাবত কোনো আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হয়নি, হবে বলেও মনে হচ্ছে না। বিশ্বরাজনীতি এখনো নির্ভর করছে শক্তির যুক্তির ওপর। অথচ আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করছেন, আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। আর এই বুদ্ধিজীবীরা ঘিরে আছেন প্রধানমন্ত্রীকে।

বেগম জিয়া দেশে ফিরলেন। তিনি আরাকান পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছেন জানি না। নির্বাচন নয়, আরাকানের বিষয়টি পাওয়া উচিত তার চিন্তায় বিশেষ অগ্রাধিকার। আমার মনে পড়ে, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর যখন আওয়ামী লীগ চাকমা নেতা সন্তু লারমার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করে, তখন বেগম জিয়া করেছিলেন এর তীব্র প্রতিবাদ। এই চুক্তি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু সন্তু লারমা চাচ্ছেন, এই চুক্তির বাস্তবায়ন। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান হয়ে পড়বে বাংলাভাষী মুসলমানশূন্য। তাদের অবস্থা হয়ে পড়বে কতকটা রোহিঙ্গাদেরই মতো। কেবল তাই নয়, এই তিন জেলার ওপর থাকবে না বাংলাদেশ সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ।

আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের যে নজির স্থাপন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার বুদ্ধিজীবীরা, তা সম্পূর্র্ণভাবেই হলো বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। এ রকম কোনো চুক্তি আমরা আরাকানের ক্ষেত্রেও আর দেখতে ইচ্ছুক নই। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা চিরকাল ভেবেছেন, ইসলাম মানুষকে ধর্মান্ধ করে তোলে; কিন্তু তারা এখন দেখেও দেখতে চাচ্ছেন না, মিয়ানমার কিভাবে বৌদ্ধধর্ম নির্ভর করে হয়ে উঠতে চাচ্ছে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী। মিয়ানমারের সেনাপতি মিন অং হিলাইংয়ের সাথে আলোচনা করে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। কেননা তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর চেয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অনেক উন্নত ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত। মিয়ানমারের বৌদ্ধ তাত্ত্বিক গুরু আশিন উইরাথু ভয়ঙ্কর ধরনের ইসলামবিরোধী। তিনি চান না আরাকানে রোহিঙ্গারা বসবাস করুক। মিয়ানমারের সব বৌদ্ধ যে ইসলামবিরোধী, তা কিন্তু নয়। মিয়ানমারে সান’রা বৌদ্ধ। কিন্তু তারা ম্রনমাদের মতো ইসলামবিরোধী নয়। তারা দিচ্ছে মুসলমানকে আশ্রয়। মিয়ানমার ঠিক এক জাতির রাষ্ট্র নয়। সেখানে আছে কারেন, সান, চীন, মনস প্রভৃতি জাতি। তাদের প্রত্যেকের আছে নিজ নিজ ভাষা। আর তারা চাচ্ছে প্রত্যেকেই স্বাধীন হতে। এদের মধ্যে কারেন’রা হলো সবচেয়ে রণনিপুণ। কারেন’রা বেশির ভাগই হলো খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নয়। রোহিঙ্গারা যদি কারেনদের মতো সুসংগঠিত হতে পারত, তবে আজকে তাদের এই দুর্দশা হতো না। একসময় ইসলামে জিহাদকে একটি আরকান হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু এখন আর তা মনে করা হচ্ছে না। মনে হয় এটা একটা বড় ধরনের বিভ্রান্তি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/261752