২০ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৩৩

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্সের নামে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হয়রানি চরমে

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ : ক্লিয়ারেন্সের কথা বলে দীর্ঘসময় বসিয়ে রাখা হয় * সিআইপিদের আটকে দিলেও দুর্নীতিবাজ, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরোধী লোকজনের ক্লিয়ারেন্সের দরকার হয় না * এতে ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে সরকারের
বিদেশ যাওয়ার সময় ক্লিয়ারেন্সের নামে চরম হয়রানি আর হেনস্তা হতে হচ্ছে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের। এ তালিকায় সিআইপি ক্যাটাগরির লোকজন ছাড়াও প্রথমসারির ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি রয়েছেন। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না জানিয়ে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায়নি বলে দীর্ঘসময় বসিয়ে রাখা হয়। একপর্যায়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে পাসপোর্ট রিলিজ করা হয়।

সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনায় ভুক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যুগান্তরকে কয়েকজন জানান, এটি রীতিমতো তাদের জন্য অসম্মান। পাসপোর্ট আটকে রেখে ভাবখানা এমন দেখানো হয়, যেন কত বড় অপরাধী দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন (!) অথচ বাস্তবতা হল, যারা প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিবাজ ও দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের কোনো সমস্যা নেই। একেবারে ভিআইপি মর্যাদায় বহাল তবিয়তে বিদেশে যাওয়া-আসা করছেন। তারা বলেন, আসলে সরকারের পক্ষ থেকে কাদের বিষয়ে কী নির্দেশনা আছে, সেটি অনেকটা অস্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও যথেষ্ট। না হলে সংশ্লিষ্ট যাত্রীকে কেন ক্লিয়ারেন্সের নামে আটকে রাখা হবে? বরং প্রথমেই তাকে বলা উচিত, আপনি এই কারণে দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না। আরও ভালো হয়, তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে আইনি ব্যবস্থা নিলে। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। তাই তারা মনে করেন, বিদেশ যাওয়ার সময় এখন সমাজের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। আর এ ধরনের যুক্তিহীন হয়রানি যদি সরকারের দায়িত্বশীল মহলের নির্দেশে না হয়ে থাকে, তাহলে যারা করছেন তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের বক্তব্য উন্নত দেশগুলোয় বিমানবন্দরে আসার আগেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাদের নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যান। কিন্তু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সে ব্যবস্থা তো দূরের কথা, অনেকে ইমিগ্রেশনসহ সব ব্যবস্থা শেষ করে বিমানে ওঠার পরও তাদের সেখান থেকে নামিয়ে আনার ঘটনা ঘটে। আবার অনেককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বসিয়ে রাখা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক যুগান্তরকে বলেন, মূলত দেশের দুর্নীতিবাজ, শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা, রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্লিয়ারেন্স নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। এর বাইরে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না। বিশেষ করে যদি কাউকে ক্লিয়ারেন্সের নামে আটকে রেখে শেষ মুহূর্তে যাওয়ার অনুমতি দেন, তাহলে সেটি ওই ব্যক্তির জন্য খুবই অসম্মানজনক।
সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিদেশ যাওয়ার সময় অনেকটা ঢালাওভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তি দেখলেই তাদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকেন। অহেতুক নানা প্রশ্নবাণে হেনস্তা করেন। গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্সের কথা বলে দীর্ঘসময় বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখেন। অনেকের কাছ থেকে মুঠোফোন সেটও নিয়ে নেয়া হয়। ইদানীং এ ধরনের অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ ধরনের ক্লিয়ারেন্সের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নীতিমালা কিংবা গাইডলাইন নেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। কারা এ ক্লিয়ারেন্সের আওতায় পড়বে, তারও কোনো সুস্পষ্ট গাইডলাইন নেই। বিমানবন্দরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই মূলত তাদের নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী যাত্রীদের আটকে দিচ্ছেন। অনেক সময় যাদের কোনো ধরনের ক্লিয়ারেন্সের দরকার নেই তাদেরও হয়রানি করা হচ্ছে।

বিমানবন্দরের বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (অ্যাভসেক) নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। বিভিন্ন বাহিনী থেকে আসা অ্যাভসেক সদস্যরা কেউ কারও নেতৃত্ব মানছেন না। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা অপারেটর, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কেউ কারও কথা শুনছেন না। মোটকথা, বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নামে সংস্থাগুলোর সদস্যরা নিরাপত্তার অজুহাতে চরম বাড়াবাড়ি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সেবা প্রদানের নামে এসব বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য বিমানবন্দরজুড়ে তৈরি করেছেন একধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি। দেশি-বিদেশি যাত্রীরা সেবার পরিবর্তে প্রায় এসব বাহিনীর সদস্যদের হাতে হচ্ছেন নাজেহাল। অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও এদের রোষানলে পড়েন।

খোদ বিমানবন্দরে কর্মরত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এভিয়েশন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এসব কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ আছে, নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্সের নামে যাত্রী হয়রানি, যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। মিথ্যা ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘুষ নেয়াসহ মুদ্রা পাচার, সোনা পাচার, আদম পাচার ও চোরাকারবারি গডফাদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন অনেকে। গত সপ্তাহে অ্যাভসেকের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে হাতেনাতে স্বর্ণ পাচারকালে গ্রেফতার করা হয়।
এছাড়া সিভিল এভিয়েশনের কতিপয় অসাধু নিরাপত্তা অপারেটর, সুপারভাইজার, ক্লিনার, নিরাপত্তা গার্ড, ইমিগ্রেশন পুলিশ, বিমানের পাসপোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ), আনসারদের বিরুদ্ধেও রয়েছে যাত্রী হেনস্তা, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ।
একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞের মতে, বিমানবন্দরে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি ২৪টি সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু এসব সংস্থার অধিকাংশ সদস্য জানে না তাদের নিজদের কাজ কী? মাঝে মধ্যে এরা নিরাপত্তা পাস নিয়ে বিমানবন্দরের এমন এলাকায় চলে যান যেখানে তাদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না।
সম্প্রতি বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের এভিয়েশন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এ সময় তারা বলেন, নিরাপত্তার নামে এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। অহেতুক যাত্রী ও দর্শনার্থীদের হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকমানের স্ক্যানিং হচ্ছে না যাত্রী ও লাগেজের। একই মানের জনবলও তৈরি হয়নি বলেও তারা অভিযোগ করেন।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/20/164791