১৯ অক্টোবর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১:০৯

উন্নয়ন ও প্রগতির নিচে চাপা পড়ছে মানুষ

গত ১৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলেছেন। যেমন সুন্দরী প্রতিযোগিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রসাধনী কোম্পানীর ব্যবসার প্রসারে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ‘নারীকে পণ্য’ করে তোলা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা দেখি বিউটি কনটেস্ট হচ্ছে, বিউটি কনটেস্ট নিয়ে একটা হট্টগোল হচ্ছে। বিউটি কনটেস্ট হচ্ছে নারীকে পণ্য করা। যারা সৌন্দর্যের প্রসাধন তৈরি করে, সেই সব কোম্পানী বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার এই কাজ করে। তারা বলে এই প্রসাধন ব্যবহার করলে তুমি সুন্দরী হতে পারবে, তুমি বিশ্বসুন্দরী হতে পারবে। তাদের পণ্য বিক্রির জন্য বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা হয়। মেয়েদের এভাবে পণ্য করে তোলা হচ্ছে।

প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, পুঁজিবাদ ছলেবলে ও কৌশলে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের উন্নতির কথা বলে পুঁজিবাদ ছলনা করছে। উন্নতির কল্পকাহিনী দিয়ে অন্যের অবনতি করছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ এই উন্নতির নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও যারা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করেন, কিছু উচ্ছিষ্ট-সুবিধা পাওয়ার আশায় তাদের মধ্যে কেউ-কেউ পুঁজিবাদের পক্ষে চলে যান। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি কিছু কথা বলেন। পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষগুলো সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে মন্তব্য করে দৃষ্টান্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা তুলে ধরেন এবং বলেন, ট্রাম্প একটা উন্মাদ, একটা অর্ধশিক্ষিত মানুষ- সবচেয়ে উন্নত দাবিদার রাষ্ট্রের প্রধান হয়েছেন তিনি। সেই ব্যক্তি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিতে চাচ্ছেন। প্রফেসর চৌধুরী আরো বলেন, ভারতে এমন একজন ক্ষমতায় এসেছেন, যার কাছে মানুষের চেয়ে গরু অনেক মূল্যবান। গরু রক্ষা করার জন্য তিনি মানুষ হত্যা করছেন। তিনি সেই দলের লোক, যে দল মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছে। আর মিয়ানমারের নেত্রীর রূপ দেখে অনেকে তাকে চিনতে পারেনি। আসলে তারা একই ধরনের মানুষ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সুন্দরী প্রতিযোগিতা এবং বিশ্বপরিস্থিতি প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প, অং সান সু চি ও নরেন্দ্রমোদি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। আমরা অতীতেও লক্ষ্য করেছি, তিনি যখন কোনো বিষয়ে কথা বলেন তখন একটা দার্শনিক ভিত্তির ওপর অবস্থান করে স্পষ্ট করেই কথা বলেন। এবারও তেমনি করেছেন। ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা অবশ্য এভাবে কথা বলতে পারেন না। এ কথার অর্থ আবার এই নয় যে, প্রফেসর চৌধুরীর সব কথার সাথেই আমাদের একমত পোষণ করতে হবে। জীবনদর্শনের ভিন্নতার কারণে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করারও অবকাশ আছে। তবে এবার আলোচ্য বিষয়গুলোতে তিনি যে মতামত ব্যক্ত করেছেন, তা আমাদের কাছে যৌক্তিক বলেই মনে হয়েছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আলোচ্য বিষয়ে কেমন আচরণ করেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

বর্তমান সভ্যতায় নীতিভ্রষ্ট শাসকদের কারণে পৃথিবীটা ক্রমেই অমানবিক ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। দুর্বলের ওপর চলছে অবিরাম জুলুম, নির্যাতন, শোষণ ও অনাচার। শক্তিমানরা নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থে একের পর এক গঠন করেছে সুন্দর সুন্দর নামের বিভিন্ন সংঘ ও প্রতিষ্ঠান। এসবের লক্ষ্য কিন্তু ন্যায়, সম্প্রীতি কিংবা শুভ কিছু নয়। শঠতা, প্রতারণা ও চাতুর্যের এই লীলাখেলায় পৃথিবীটা ক্রমান্বয়েই মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। যার বড় প্রমাণ মিয়ানমারের গণহত্যা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা যেন কোন অপরাধই নয়। নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থে শোষিত-বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সমাজতান্ত্রিক চীন ও রাশিয়ার এখন আর লজ্জা হয় না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেলেও বর্তমান সভ্যতা নৈতিকতা, মানবিকতা ও সহমর্মিতার বিবেচনা থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। সভ্যতার সংকটও তাই ঘনীভূত হচ্ছে। তেল-গ্যাস ও বাণিজ্য মাদকতা যখন মানুষের জীবনের চাইতেও বড় হয়ে যায় তখন এই পৃথিবী আর কতদিন মানুষের পৃথিবী থাকবে?

মানুষকে মানুষ হতে হলে তো নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় ¯্রষ্টা সম্পর্কে। এমন ভাবনা মানুষকে ধার্মিক হতে শেখায়, দায়িত্ববান হতে শেখায়। দায়িত্ববান মানুষ জবাবদিহির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়। এমন মানুষ যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তিনি কখনো মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ চালাতে পারেন না। বর্তমান সভ্যতায় ভ্রষ্ট জীবনদর্শনের কারণে মানুষ চলছে ভুল রোডম্যাপে। ফলে সংকট বাড়ছে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে। জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষেও এখন সংকটের মাত্রা বাড়ছে। এ সবই মানুষের কর্মকাণ্ডের ফল।

বর্তমান সভ্যতার শাসকরা কতটা সুস্থ আছেন তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে একটা গবেষণা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ উন্মাদদের হাতে রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবী তো দূরের কথা, একটি ক্লাবের দায়িত্বও দেয়া যায় না। সত্যনিষ্ঠ কোন গবেষণার মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ যদি জানতে পারে কিছু অযোগ্য ও পাগলপ্রায় মানুষ এখন পৃথিবীকে শাসন করছে, তা হলেতো তাদের চেতনার জগতে জাগৃতি আসবে। জাগৃতি আসলে মানুষ তার কর্তব্যকর্ম স্থির করতে পারবে। সুস্থ মানুষরা যদি কর্তব্য কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন উন্মাদদের সরে পড়তে হয়। তেমন এক পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে বর্তমান পৃথিবী।

http://www.dailysangram.com/post/304101