১৮ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১০:৫০

নিরক্ষরদের জন্য বিনামূল্যের বই ছাপা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পেও সিন্ডিকেটের থাবা

দেশের ৬৪টি জেলার ২৫০টি উপজেলায় ৪৫ লাখ নিরক্ষরকে সাক্ষরতার আওতায় আনার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। এ ৪৫ লাখ জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরতার আওতায় আনতে ৫৩ লাখ ১২ হাজার ৩০ কপি বিনামূল্যের বই ‘মৌলিক সাক্ষরতা ও জীবন দক্ষতা প্রকল্প’-এর অধীনে ছাপা হবে। এ বই ছাপার কাজ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একটি সিন্ডিকেটকে ৫৩ লক্ষাধিক বই ছাপার কার্যাদেশ দেয়ার তোড়জোড় চলছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কার্যাদেশ দেয়া পর্যন্ত সব স্তরেই সরকারি ক্রয় নীতিমালা ‘পিপিআর’-এর পরিপন্থী শর্তারোপ করা হয়েছে। মুদ্রাকররা অভিযোগ করেছেন, একক বা একটি মাত্র গোষ্ঠীকে কার্যাদেশ দেয়া হলে সময়মতো বই প্রাপ্তি, বইয়ের মান নিশ্চিত করাসহ নানা ব্যাপারে সংশয় দেখা দেবে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও বই নিরক্ষর বয়স্ক শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না। এতে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পটির অর্থ লুটপাটের আয়োজন সম্পন্ন হবে।

এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক মো: শফিকুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, ওটিএম (ওপেন টেন্ডার ম্যাথড) বা উন্মুক্ত টেন্ডার পদ্ধতিতে টেন্ডার করা হয়েছে। তবে, শর্ত রয়েছে যোগ্যতার বিবেচনায় যে কেউ এ কাজ পেতে পারে। সব ধরনের স্বচ্ছতা বজায় রেখেই টেন্ডার করা হচ্ছে। সরকারি নিয়ম-আইন মেনেই সব করা হচ্ছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের অধীনে ৪৫২ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে প্রথম দিকে প্রকল্পটির কাজ শুরুর কথা থাকলেও ২০১৭ সালে অক্টোবরে এসেও এখন পর্যন্ত টার্গেট গ্রুপও নির্বাচন কাজ শেষ হয়নি। তবে কাজ চলছে। প্রকল্পটির মেয়াদ আর মাত্র আট মাস বাকি রয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এর পরিণতি আনন্দ স্কুল প্রকল্পের মতোই হবে। প্রকল্প পরিচালক এ ব্যাপারে জানান, প্রকল্পের কাজ দ্রুতই এগিয়ে চলছে।

গত মার্চের দিকে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ‘স্বাক্ষর জ্ঞান ও জীবন দক্ষতার ধারণামূলক’ সাতটি বই প্রণয়ন শেষ হয়েছে। ওই প্রকল্পের অধীনে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩ লাখ ১২ হাজার ৩০ কপি বিনামূল্যের বই ছাপা হবে। সাতটি বই হচ্ছে, আমার চেতনা ১ম ও ২য় খ -২টি বই, আমার চেতনা শিক্ষক সহয়িকা ১ম ও ২য় খ -২টি বই, শিক্ষক সুপারভাইজার ম্যানুয়াল-১টি বই, কোর ট্রেইনার ও মাস্টার ট্রেইনার গাইড বই-১টি এবং ফ্লিপ চার্ট-১টি।
জানা গেছে, এ সব বই প্রতিটি উপজেলায় ৩০০টি করে লার্নিং সেন্টারে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নিরক্ষর পুরুষ ও মহিলাদের মৌলিক সাক্ষরতা ও জীবন দক্ষতা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। প্রতিটি সেন্টারে ৩০ জন মহিলা ও ৩০ জন পুরুষকে মৌলিক সাক্ষরতার পাশাপাশি গল্প ও বর্ণনার মাধ্যমে জীবনদক্ষতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া হবে। এরই মাধ্যমে তারা সচেতন হবে স্বাস্থ্য বিষয়ে, যৌতুক, বাল্যবিয়ে, পরিবেশ ও সমবায় সম্পর্কে। মৌলিক সাক্ষরতা বলতে নিরক্ষর নারী-পুরুষকে লিখতে, পড়তে ও গণনা করতে শেখানো হবে। ৪৫ লাখ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে মৌলিক সাক্ষরতা ও জীবন দক্ষতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে।

জানা গেছে, টেন্ডারে যে সব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, তাতে হাতেগোনা কয়েকটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়ার সুযোগ পাবে। ৫৩ লক্ষাধিক বই একক কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছাপা হলে বইয়ের মান, কাগজের নির্ধারিত মাপ ও মান ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া কার্যাদেশ দেয়ার পর তা পরিদর্শন বা পর্যবেক্ষণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। যেমনটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) করে থাকে। ফলে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান যা ইচ্ছা তা-ই করার সুযোগ পাবে। ফলে মানসম্পন্ন বই প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। টেন্ডারের শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি। কারণ হিসেবে অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে কে কার দায়িত্ব নেব? অভিযোগ উঠেছে, সাক্ষরতার প্রকল্পের অতীতের কাজ যেমন লুটপাটে শেষ হয়েছে, চলমান প্রকল্পটির ভবিষ্যৎও তা-ই হতে যাচ্ছে।
এ সব অভিযোগের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া ও এর শর্তের মধ্যে সব কিছু বলা আছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৪৫২ কোটি ৫৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে ৪৫ লাখ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে কিভাবে মৌলিক স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন এবং জীবনদক্ষ করে তোলা সম্ভব? এই প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্থানীয় এনজিওগুলোকে। সরকারের অর্থাৎ উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদফতরের ভূমিকা হবে এখানে পর্যবেক্ষণকারী বা দর্শকের।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্পটির জন্য ৭৫ হাজার লার্নিং সেন্টার নির্বাচনের কাজ এখনো বাকি। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে খুঁজে বের করে তালিকাভুক্ত করা শেষ হয়নি। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ মাত্র আট মাস বাকি। ফলে ওই স্বল্প সময়ে বিশাল এই কাজ সম্পন্ন হওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বয়স্ক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, আনন্দ স্কুলের মতোই এই কার্যক্রমে সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই হবে না। আনন্দ স্কুলে ঝরে পড়াদের যেমন প্রাথমিক শিক্ষা দেয়া যায়নি। বরং প্রকল্পের টাকা এনজিওদের মাধ্যমে লুটপাট হয়েছে। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে মৌলিক সাক্ষরতা সম্পন্ন এবং জীবনদক্ষ করে তোলার পরিণতিও একই হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/260986