১৭ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫৫

ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্রাইট ও লিফ ফোল্ডারের নির্দয় আক্রমণউত্তরাঞ্চলে আমনচাষিদের স্বপ্ন ঝলসে যাচ্ছে : পাশে নেই কৃষি বিভাগ১৭ লাখ টন ধান কম উৎপাদনের আশঙ্কা

সরকার মাজহারুল মান্নান রংপুর অফিস

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা মাঠের ধানে লিফ ফোল্ডার ও ব্যাকটোরিয়াল লিফ ব্রাইটে আক্রান্ত পোকা দেখছেন কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: আবু বকর সিদ্দিক সরকার। ইনসেটে বিএলবি রোগে ঝলসে যাওয়া ধান : নয়া দিগন্তবাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের গবেষণা মাঠের ধানে লিফ ফোল্ডার ও ব্যাকটোরিয়াল লিফ ব্রাইটে আক্রান্ত পোকা দেখছেন কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: আবু বকর সিদ্দিক সরকার। ইনসেটে বিএলবি রোগে ঝলসে যাওয়া ধান : নয়া দিগন্ত

দুই দফা বন্যার ধকলই এখনো যায়নি রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের। তার ওপর এখন বিস্তীর্ণ আমনের মাঠে পাতা মোড়ানো পোকা আর ব্যাকটেরিয়ার নির্দয় আক্রমণ। চোখের সামনে বাড়ন্ত সবুজ আমনের গাছ মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখে হতাশ কৃষক। বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সবুজ ধানের ডগা। ডগা পরিণত হচ্ছে বিদ্যুৎ পোড় খাওয়ার মতো ঝলসানো খড়ে। রোগ বালাইয়ের বেপরোয়া আক্রমণে চাষিদের আতঙ্ক বাড়ছেই। তারা উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু তাদের পাশে নেই কৃষি বিভাগ। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা ওপথই মাড়ান না। ডিলারদের কাছ থেকে ওষুধ নিয়েও মিলছে না সমাধান। উপরন্তু গচ্চা যাচ্ছে টাকা। কৃষিবিদ ও কৃষকেরা বলছেন, এই অবস্থার ত্বরিত সমাধান করা না গেলে দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলে আমনের ফলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ লাখ মেট্রিক টন কম হতে পারে। তবে ধানবিজ্ঞানীরা বলছেন, আক্রান্ত এলাকায় একসাথে লিভ ফোল্ডারের জন্য নিয়মমত ওষুধ এবং বিএলবির জন্য শুধু ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করা গেলেই মিলবে সমাধান।

রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন মাঠে সরেজমিন অনুসন্ধান এবং পঞ্চগড়, বগুড়া, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মাঠপর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এবারের দুই দফা বন্যায় এই অঞ্চলের আমন চাষিরা এমনিতেই দিশেহারা। তারপরও অনেক কষ্টে, ধার দেনা করে, গরু ছাগল বিক্রি করে, চড়া সুদে এনজিও এবং মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আমন রোপণ করেছিলেন তারা। কিন্তু এখন হতাশা আতঙ্ক আর উদ্বেগ তাদের চোখে মুখে। বিস্তীর্ণ মাঠে সেই আমন ধানের সবুজ গাছ যখন বেড়ে উঠছে লকলকিয়ে, কাইচথোর যখন আসন্ন। থোর ও ধানের দানা বাঁধার যখন মোক্ষম সময়, ঠিক তখনই লিফ ফোল্ডার ও বিএলবি বা ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্রাইট রোগের থাবায় বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ। হতাশায় বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছেন কৃষক। এই অঞ্চলের মাঠের এখন ৩০ ভাগ আবাদেরই বিবর্ণ দশা। আমনের সবুজ গাছ এখন ঝলসানো। বাজ পোড়ার মতো হয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত সব আমনের জমি। আমনের সবুজ পাতা ঝলসে পরিণত হয়েছে খড়কুটোয়। অনেক জায়গায় সবুজের পরিবর্তে আমনের গাছ হয়ে যাচ্ছে হলুদ।

সরেজমিন এসব আক্রান্ত জমিতে গিয়ে দেখা গেছে, দশমিক ৫ থেকে ১ সেন্টিমিটার সবুজ-সাদা বর্ণের পোকা পাতার ওপরে আক্রমণ করে। এরপর সেখানে বাসা বেঁধে পাতাকে খড়ের মতো করে ফেলছে। আর বিএলবি বা ব্যাকটেরিয়াল লিফ ব্রাইট পাতার ওপরে আক্রমণ করে ঝলসে দিচ্ছে। ফলে পুরো ধানগাছ আর বাড়তে পারছে না। প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। মরে যাচ্ছে।
মরা মাঠে হতাশ কৃষক : পাশে নেই কৃষি বিভাগ
সরেজমিন এই অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, আক্রান্ত বিবর্ণ আমন ক্ষেতের পাশে অসহায় হয়ে হাপিত্যেস করছেন চাষিরা। মরা আর ঝলসানো ফসল নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই তাদের। রোগবালাই প্রতিরোধে আবার নতুন করে ধার কর্জ করে, ঋণ নিয়ে টাকা ম্যানেজ করে ওষুধ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। এমনও কৃষক আছেন যারা দিনে তিনবার স্প্রে করেছেন। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। সকালে এক জমিতে, দুপুরে আরেক জমিতে বিকেলে অন্য জমিতে আক্রমণ করছে এই পোকা আর ব্যাকটেরিয়া। রাতে যে জমি সবুজ দেখে গেছেন কৃষক সকালে গিয়ে তা দেখছেন বিবর্ণ।

গেল বৃহস্পতিবার। বেলা ৩টার কাছাকাছি তখন। রংপুরের মিঠাপুকুরের কাফ্রিখাল ইউনিয়নের মকরমপুর গ্রামের পথ ধরে যেতেই চাষিদের শোরগোল। কেউ রাস্তায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ জমিতে ওষুধ দিচ্ছেন। কোনো জমিতে কৃষক, আইলে অপেক্ষমাণ কিষানী। মকরমপুর গ্রামের সামর্থ্যবান কৃষক শাহেদুল ইসলাম। তিনি জানালেন, এক একর ৩৫ শতক জমিতে আমন লাগিয়েছেন এবার। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত এক একর ২০ শতক জমিতেই পোকার আক্রমণ হয়েছে। তিন দফায় ওষুধ দিয়েছেন। কোনো কাজ হচ্ছে না। স্থানীয় কুমরগঞ্জ বাজারের আবুবকরের দোকান থেকে নাইট্রো, ভেত্তাকো, আলভা, পেসকিল ওষুধ এনে স্প্রে করেছেন। কোনো কাজ হয়নি। তিনি জানান, ১০-১২ বছর আগে এই পোকা আক্রমণ করেছিল। তার দাবি এই পোকার কারণে যে জমিতে ২০ মণ ধান হয়েছিল। তা এসে দাঁড়াবে পাঁচ মণে। হতাশ এই চাষি বলেন, এবার আলুতেও লোকসান হয়েছে। ধানও পোকায় খড় বানাচ্ছে। প্রতি বছরই তাকে জমি বন্দক রেখে পোষাতে হচ্ছে। সংসার চালাতে হচ্ছে। এসব ভেবে উদ্বিগ্ন তিনি।
তার কাছে প্রশ্ন ছিল, জমিতে পোকার আক্রমণ, এখানকার বিএস বা সরকারি লোকের কাছে গিয়েছেন কিনা। কিংবা তারা এসেছিলেন কি না। উত্তরে তিনি বললেন, এলাকার বিএস বা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার নামও জানেন না তিনি। বা তার সাথে কোনো পরিচয়ও তার নেই। লুঙ্গির প্যাচ থেকে তিনি নিজেই মোবাইল বের করে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে ফোন দিলেন। তার কাছ থেকে জেনে এ প্রতিবেদককে বললেন, বিএস-এর নাম তরিকুল ইসলাম। কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান ওই কৃষককে ফোন ব্যাক করে জানালেন, ওই এলাকার বিএস-এর নাম তরিকুল নয়, আবদুল ওয়াহাব। এরপর তিনি নয়া দিগন্তকে জানালেন, ওয়াহাব যে বিএস তা আমি কেবলই শুনলাম। ওনি সম্পর্কে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও হন। তবে তিনি কোনো দিনও আমাদের গ্রামের কারো কাছে আসেননি। জমির ভালো মন্দের ব্যাপারে কখনই পরামর্শ দেননি। তবে আবদুল ওয়াহাবের স্থানীয় জায়গীরহাটে ওষুধের দোকান আছে। তিনি মাঠ পরিদর্শন না করে সেই দোকানেই সময় কাটান।

কথা বলতে বলতেই অনেক কৃষক এসে হাজির হলো দীঘির পাড়ের ছায়ায়। একই গ্রামের কৃষক আবদুল ওয়াদুদের স্ত্রী কিষানী রোজিনা বেগম। তিনি জানালেন, এবার ৬০ শতক জমি আবাদ করেছেন। তার মধ্যে ২০ শতকেই এই পোকা আক্রমণ করেছে। ডিলারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসে চারবার স্প্রে করেছেন। কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারি লোক কখনই আমাদের গ্রামে আসেন না। আমরা দোকানে গিয়ে রোগের কথা বলে ওষুধ নিয়ে আসি।
অন্য কৃষক ফজলুল হক জানান, আমার ৮০ শতক জমিতে পোকা ভর করেছে। বিএসের বাড়ি নাকি আমাদের ওই এলাকাতে। ও যে কোথায় যায় বুঝতে পারি না। ও তো আমাদের এলাকাতেই আসে না। সরকারি লোকের কোনো পরামর্শ আমরা পাই না। তাই বাধ্য হয়ে ডিলারের কাছে যাই। ওষুধ নিয়ে আসি, ছিটাই। কিন্তু পোকা বাড়তেই আছে। আবার কয়েক দিন পর যাই। দোকানদার অন্যটা দেয়। সেটি আনি ছিটাই। কিন্তু পোকা মরছে না। আমরা কৃষকেরা কিভাবে বাঁচব।
কৃষক সেকেন্দার আলী জানান, মাঠের পর মাঠ এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা তো আসেনই না। একই গ্রামের অন্য কৃষক লাল মিয়া জানালেন তিন একর জমির মধ্যে ৭০ শতকে আক্রমণ করেছে এই রোগ। রাতে যে জমি ভালো দেখে আসি। সকালে গিয়ে দেখি সেই জমি খড় হয়ে যাচ্ছে। এই খড় এখন গরুও খাবে না। এবার যে কি অবস্থা হবে। কি দিয়ে সংসার চালাব বুঝতে পারছি না। এই মকরমপুর গ্রামের চান মিয়ার এক একর, তোফাজ্জলের ৪০ শতক জমির মধ্যে ৪০ শতক, রওশন আরার ৮০ শতক, সেকেন্দার মিয়ার ৮০ শতক, হাফিজুর রহমানের পাঁচ বিঘার মধ্যে তিন বিঘা, আবদুস সালামের চার বিঘার মধ্যে তিন বিঘা, নুরুজ্জামানের চার বিঘার মধ্যে চার বিঘা, রাজু মিয়ার দুই বিঘার মধ্যে এক বিঘা জমিতে এই পোকা ও ব্যাকটেরিয়ায় আক্রমণ হয়েছে। এই গ্রামের কিষানী জাহানারা বেগম জানান, সরকারি লোক যে হাজার হাজার টাকা বেতন পায়। তাদের তো উচিত আমাদের জমির খোঁজখবর নেয়া। পরামর্শ দেয়া। আমরা তো তাহলে এই উপদ্রব থেকে বাঁচতাম। কিন্তু তারা তো কোনো দিনও আমাদের কাছে এলো না। পরামর্শও দিলো না।

মকরমপুর গ্রামের যুবক কৃষক রাজ মিয়ার চোখে মুখে রাজ্যের ক্ষোভ। তিনি জানালেন, আমার চার বিঘা জমিতেই এই পোকার আক্রমণ হয়েছিল। আমি ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে এনে ছিটিয়ে কোনো কাজ হয়নি। একজনের পরামর্শে আমি বিএসের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাকে বাড়িতেও পাইনি। পরে শুনি তার জায়গীর দোকান আছে। সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ওনি ওষুধ কোম্পানির লোক নিয়ে ব্যস্ত। পরে রংপুর শহরের মডার্ন মোড়ে আমার এক পরিচিত বিএস ছিল। তার কাছে যাই পরামর্শ নেয়ার জন্য। তিনি সব শুনে আমাকে বলেন, কোনো কাজ হবে না বরং ধান কেটে ফেলো। বাধ্য হয়ে আমি চার বিঘা জমির ধানগাছই কেটে ফেলেছি। এখন যে খড় হয়েছে তাও আর গরু খায় না।
হঠাৎ হাজির উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা
কৃষকদের সাথে কথা বলতে আর ছবি তুলতেই কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে মকরুমপুর গ্রামের সেই স্থানে এলেন ওই ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবদুল ওয়াহাব। তিনি এসেই নিজেকে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিতেই কৃষকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। সেখানেই কৃষকদের অভিযোগ সত্য না মিথ্যা এই প্রশ্ন করলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানালেন, কৃষকদের অভিযোগ মিথ্যা নয়। তবে আমি আসি। হয়তো আমি যখন আসি, তখন এনাদের সাথে আমার দেখা হয় না। আর জায়গীরে আমার ছেলের ওষুধের দোকান আছে। আমি অফিস টাইম শেষে সেখানে বসি। তবে উপস্থিত অন্তত ১৫ জন কৃষক ও কৃষানী জানালেন, ওনার বাড়ি পাশের গ্রামে। ওনি যে আমাদের এলাকার বিএস এটি আমরা কেবলই জানলাম। ওনি কোনো দিনই আসেননি। উঠান বৈঠক কিংবা কাউকে কোনো পরামর্শ দেননি। তবে জানা গেল, শাহেদুল ইসলাম নামের যে কৃষক ওই এলাকার উপসহকারী কে তা শোনার জন্য যখন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন দিয়েছিলেন তার মাধ্যমে খবর পেয়েই তিনি ওখানে ছুটে আসেন।

অন্য দিকে শুক্রবার ওই উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের ইদুলপুর গ্রামে গিয়েও দেখা গেল মাঠের অবস্থা আরো ভয়াবহ। মাঠে সবুজের নাচনির বদলে পোড়া খড়ের ঝলসানো অবয়ব। সেখানে আশেক আলী নামের এক কৃষক জানালেন, তার পাঁচ বিঘা জমিতে ধরেছে এই পোকা। কোনো কাজ হচ্ছে না ওষুধ দিয়ে। নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে ওষুধ দিচ্ছি কাজ হচ্ছে না। এ পর্যন্ত তিনবার ওষুধ দিয়েছেন। এই গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানালেন, এই রোগের কী সমস্যা। আমরা তো বুঝতে পারছি না। একেক দোকানি একেক ওষুধ দেয়। আজকে এ দোকানে গেলাম। সেখান থেকে নিয়ে আসি। কোনো কাজ হয় না। কাল ও দোকানে যাই। সে আবার নতুন ওষুধ দেয়। তাতেও কাজ হয় না। আমরা কৃষকেরা এখন কূলকিনারা পাচ্ছি না। কি ওষুধ দেবো আর না দেবো। বিএসের তো দেখাই নেই। এত বড় একটা সমস্যা। বিএস এসে তো বলবে। ভালোমন্দ পরামর্শ দেবে। কিন্তু সে রকম কিছুই পাচ্ছি না আমরা। যার কারণে দোকানদারের শরনাপন্ন হতে হয়।

এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুলতানা আখতার কল্পনা নয়া দিগন্তকে জানান, হেক্টর হেক্টর জমিতে পোকা লেগেছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ নিশ্চুপ। বারবার বিষয়টি কৃষি কর্মকর্তাদের জানানো হলেও তারা গায়ে লাগাচ্ছে না।
গঙ্গাচড়ার নোহালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবুল কালাম আজাদ টিটুল নয়া দিগন্তকে জানান, আমার ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ এলাকার আমন ধান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক কষ্ট করে আবার কৃষকেরা জমিতে আমন লাগায়। কিন্তু তাতে এখন এমন পোকা ধরেছে। যে পুরো জমি খড় হয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, আমার ইউনিয়নবাসীর ওপর এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। কিন্তু কৃষি বিভাগকে আমরা পাশে পাচ্ছি না। এ জন্য কৃষিমন্ত্রীর মনিটরিং দাবি করেন এই জনপ্রতিনিধি।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাঠেও পোকা
এ দিকে শুধু মাঠেই নয়, খোদ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভেতরের গবেষণা মাঠের জমিতেও আক্রমণ করেছে এই পোকা ও ব্যাকটেরিয়া। রংপুর কৃষি জোনে এবার এর ব্যাপকতার কথা জানালেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
পোকার কারণ ও প্রতিরোধে ধান বিজ্ঞানীর পরামর্শ
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: আবুবকর সিদ্দিক সরকার নয়া দিগন্তকে জানান, লিফ ফোল্ডার বা পাতা মোড়ানো পোকা আলোক ফাঁদ, পার্সিং এবং নেট জাল দিয়ে সুইপিং করার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব। যদি এই তিন পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ না হয়, তাহলে পরিমাণ মতো সেমিন, ডার্সবাম, মিপসিন, মার্শাল জাতীয় ওষুধ স্প্রে করলেই এই পোকা দমন সম্ভব।
অন্য দিকে বিএলবি প্রতিরোধের জন্য কোনো ওষুধ নেই। বিএলবি আক্রমণ হওয়ার সাথে সাথেই প্রতি পাঁচ শতক জমির জন্য দশ লিটার পানিতে ৬০ গ্রাম লিকুইড সালফার থিয়োভিট, ৬০ গ্রাম পটাশ সার, ৩০ গ্রাম দস্তা সার একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
এই কৃষি বিজ্ঞানীর পরামর্শ দুটো রোগের জন্যই দুপুরের পরে আক্রান্ত এলাকায় একসাথে স্প্রে করা গেলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, একজন একজন করে করলে এই রোগ আবার নতুন করে অন্য জমিতে আক্রমণের আশঙ্কা বেশি।
কৃষি বিভাগের বক্তব্য

রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের তথ্য কর্মকর্তা ও উপপরিচালক কৃষিবিদ মো: মনিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে জানান, এখন পর্যন্ত আমাদের রংপুর জোনের পাঁচ জেলায় চাষ হয়েছে পাঁচ লাখ ৯৩ হেক্টরে আমন ধান। আমন ফসলের বর্তমান অবস্থা ভালো আছে। তবে পোকা আর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এরই মধ্যে জেলা, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের এসওদের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। যাতে পোকায় কোনো ধরনের ফসল নষ্ট করতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তাদের। এখন মাঠে যে আবহাওয়া বিরাজ করছে তাতে পোকা আরো বাড়তে পারে। এ জন্য আমার আগাম সতর্ক বাণী প্রচার করছি যাতে কোনো ধরনের ফসল নষ্ট না হয়। কোনো এসও’র ব্যাপারে যদি এলাকায় অভিযোগ পাই বা আমরা যদি দেখতে পাই যে ওই এলাকার মাঠ পোকায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবে তার বিরুদ্ধে চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ দিকে রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী আঞ্চলিক খামার বাড়ির তথ্যে প্রকাশ, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ২১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ হেক্টরে এবার আমন লাগিয়েছিলেন কৃষকেরা। এবার এই পরিমাণ জমি থেকে ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে কৃষি বিভাগের। সরেজমিন অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্র এবং বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে এবার এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশ আমন জমিতে এই রোগ দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা প্রটেকশন দেয়া না গেলে এই অঞ্চলে ১৭ লাখ টন আমন ধান কম উৎপাদন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/260723