১৭ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫১

পুঞ্জীভূত ৪৫ হাজার কোটি টাকা দেনার দায় ঢাকতে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে পিডিবি

কামাল উদ্দিন সুমন : সুযোগ থাকার পরও দেনার দায় থেকে দূরে সরতে পারছে না বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বরং প্রতি অর্থবছরে পিডিবির দেনা বাড়ছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছিল ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা। আর এ দেনার দায় ঢাকতে বিদ্যুতের দাম বারবার বাড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এর শিকার হচ্ছে বিদ্যুৎ গ্রাহকরা।

সূত্র জানায়, নিজস্ব উৎপাদনের চেয়ে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়েই বেশি আগ্রহী বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। আবার বেশি ব্যয়ের কেন্দ্র থেকেই বেশি বিদ্যুৎ কিনছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন বিলম্বে বাড়ানো হচ্ছে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মেয়াদ। অনুমোদন দেয়া হচ্ছে নতুন রেন্টাল-কুইক রেন্টালেরও। বাড়তি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি থেকে বেসরকারি এসব কেন্দ্র মুনাফা বাড়ালেও আর্থিকভাবে ভঙ্গুর হচ্ছে বিপিডিবি। এক দশকেই প্রতিষ্ঠানটির পুঞ্জীভূত দেনা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

দেনার পরিমাণ যে উত্তরোত্তর বাড়ছে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সম্প্রতি গণশুনানিতেও তা তুলে ধরে বিপিডিবি। এর কারণ হিসেবে বিপিডিবি জানায়, ঋণ নিয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। আবার অর্থের অভাবে বিপিডিবি নিজেদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওভারহোলিং, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক বিবরণী গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বেসরকারি খাত থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় শুরু করার পর থেকেই বাড়তে থাকে বিপিডিবির দেনার পরিমাণ।

বিপিডিবির হিসাবে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছিল ৯১৫ কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত দেনা বেড়ে হয় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর আরো ১ হাজার কোটি টাকা যোগ হয়ে দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকায়। ২০১০-১১ অর্থবছরেই ৪ হাজার ১১৬ কোটি টাকা নতুন দেনা সৃষ্টি হয়। অর্থবছরটিতে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত দেনা দাঁড়ায় ৭ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আরো ৬ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা যুক্ত হয়ে পুঞ্জীভূত দেনা ১৩ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭৬৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ২৬ হাজার ৪৮৪ কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৩৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৩৯ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৫ হাজার ১২২ কোটি টাকা বেড়ে বিপিডিবির পুঞ্জীভূত দেনা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ট্যারিফ ঘাটতি মেটাতে নেয়া ঋণের অংক ৩৯ হাজার ৬১০ কোটি ও সুদ ৪ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

এ বিপুল আর্থিক চাপ সামাল দিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে দাবি করেন বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ। তিনি বলেন, পুরনো কেন্দ্রে রিপাওয়ারিংসহ বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের সংকট থাকায় তেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প নেই। আর কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা সময়সাপেক্ষ।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্যই রাষ্ট্রীয় অর্থের নয়ছয় হচ্ছে। যা পিডিবি করছে। দরপত্র ছাড়াই ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতিতে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়। এ কারণে কম দামে বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে কেনার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি থাকে। এর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের অনেকে জড়িত। যে কারণে এটা বন্ধ হচ্ছে না। বরং বিদ্যুতের দাম আরও বাড়াতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তিনি বলেন, দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা উচিত। একই সঙ্গে যারা কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে আগ্রহী, তাদেরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ দেয়া এবং তাদের কাছ থেকে কম দামে বিদ্যুৎ কেনা উচিত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। তার মতে, এটা সম্ভব হলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।

http://www.dailysangram.com/post/303818