১৬ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫২

অতি মুনাফায় ফুলে ফেঁপে উঠছে বেসরকারি বিদ্যুৎ খাত

২০১০ সালের পহেলা মার্চ থেকে অদ্যাবধি বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে ৭বার এবং পাইকারি পর্যয়ে ৫ বার বৃদ্ধি করা হয়েছে। আরেক দফা দাম বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে গণশুনানি শেষ করেছে বিইআরসি। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পেছনে বিদ্যুৎ খাতের লুটেরা সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা । তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে আরো কমানো সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট বন্ধ করা। ভয়াবহ লুটেরা সিন্ডিকেট এখাত থেকে বিভিন্ন কৌশলে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করছে। আর এর শিকার হচ্ছে সাধারণ গ্রাহক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতের লুটের টাকা ভাগবাটোয়ারা হয় বিভিন্নপর্যায়ে। একদিকে দাম বাড়নোর মাধ্যে বারবার গ্রাহকদের পকেট কাটা হচ্ছে । অন্যদিকে বেশী দামে বিদ্যুৎ কেনার নামে সরকারি টাকা খরচ করে অতিরিক্ত মুনাফা দিচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে। পক্ষান্তরে দুইদিকেই লাভবান হচ্ছে সিন্ডিকেট।

অভিযোগ আছে, খোদ পিডিবির একটি সিন্ডিকেট আছে যারা বেশি দামে বেশি বিদ্যুৎ কিনতে আগ্রহী। এ কারণে গত ৬ বছরে লোকসান হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ। যেসব পাওয়ার প্ল্যান্টের বিদ্যুতের দাম যত বেশি, সেসব কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনতে তত বেশি আগ্রহী পিডিবি। রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি কোন ধরনের নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্যারিফ ঘাটতির কথা বলে বিপিডিবি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও যাদের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ কিনছে, সেই বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলোর মুনাফা বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় সব কোম্পানিরই নিট মুনাফা বেড়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৪ হিসাব বছরে ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের নিট মুনাফা ছিল ১৬ কোটি টাকার নিচে। বিপিডিবির কাছে আরো বেশি বিদ্যুৎ বিক্রি করায় ২০১৭ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসেই তা প্রায় ৫৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৪ হিসাব বছরে সামিট পাওয়ার লিমিটেডের নিট মুনাফা ছিল ২২২ কোটি টাকা। ৩০ জুন সমাপ্ত হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেই তা ৩০২ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের মুনাফা ২০১৪ হিসাব বছরে ৮৪ কোটি টাকার কম থাকলেও চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তা ১৪১ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ২০১৪ হিসাব বছরের ১২ মাসে শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ৪৭ কোটি টাকা, সর্বশেষ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসেই তা ৭৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৪ হিসাব বছরে বারাকা পাওয়ারের মুনাফা ছিল প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাব বছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটির নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।

বিপিডিবির উৎপাদন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর মোট ৩৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে বেসরকারি, রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি খাতের ছিল ১৩টি। প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার ৭০ শতাংশই ছিল বিপিডিবির। অর্থাৎ বিপিডিবির নিজস্ব উৎপাদন ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট। বর্তমান সক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হলেও বিপিডিবির নিজস্ব উৎপাদন এখনো সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় বিপিডিবির হিস্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশে।

এ অবস্থায় সম্প্রতি আরো ১০টি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার ৭৬৮ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ব্যয় হবে ইউনিট প্রতি ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে ১৯ টাকা ৯৯ পয়সা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ ধরা হয়েছে পাঁচ থেকে ১৫ বছর।

এতো মুনাফার পর আবারো পাইকারিতে বিপিডিবি ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ৮৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও ৫৭ পয়সা বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। কমিটির সদস্য মো. কামরুজ্জামান বলেন, বিদ্যমান গড় পাইকারি মূল্যহার ইউনিটপ্রতি ৪ টাকা ৮৪ পয়সা। সরকারি আর্থিক সহায়তা ছাড়া বিপিডিবির নিট রাজস্ব চাহিদা ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ৪১ পয়সা। এ হিসাবে ইউনিটপ্রতি ৫৭ পয়সা বাড়ানোই যথেষ্ট।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকার কমদক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্য্ৎু উৎপাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে সরকার। এই দুর্নীতি বন্ধ এবং নীতিগত ভুল সংশোধন করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/303728