১৬ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫১

সুপ্রিম কোর্ট-প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন ॥ ১০ কর্মকর্তা বদলি

আমি অসুস্থ নই। সুস্থ আছি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এমন লিখিত বক্তব্যে আলোচনার ঝড়ে সামিল হয়েছে তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের করা ১১ দুর্নীতির অভিযোগ। সুপ্রিম কোর্ট বিবৃতিতে বলেছে, রাষ্ট্রপতি এই ১১ অভিযোগ আপিল বিভাগের চার বিচারপতিকে জানিয়েছেন গত ৩০ সেপ্টেম্বর। অনেকেরই প্রশ্ন অর্থ পাচার, দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম এবং নৈতিক স্খলনের মতো ১১টি গুরুতর অভিযোগ থাকার পরও প্রধান বিচারপতি কীভাবে বিদেশে যেতে পারলেন?

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার লিখিত বিবৃতিতে বলে গিয়েছেন রদবদল করা হবে বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপ। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অনুমোদনে আইন মন্ত্রণালয় এই রদবদল করেছে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আজ সোমবার উভয় বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছেন।

রাষ্ট্রপতি যেখানে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের কাছে সিনহার বিরুদ্ধে অভিযোগের দালিলিক তথ্য উপস্থাপন করলেন, সেখানে রাষ্ট্রপতিই বা কীভাবে প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদন মঞ্জুর করলেন? আবার ওই ১১ অভিযোগের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের অবহিত করলেন কেন?।

সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন অভিযোগ করেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে বাদ দিয়ে আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের নিয়ে আলোচনা করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। কেন করেছেন? তিনি (রাষ্ট্রপতি) প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে অন্য বিচারপতিদের ডেকে নিয়েছেন এবং তারপর তাদের বুঝিয়েছেন। এটা সংবিধানে নেই। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে গতকাল এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন।

গত ২ অক্টোবর ছুটি নেয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছিল। এরপর ছুটির মেয়াদ আরো দশদিন বাড়ানো এবং বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে গত বুধবার গভর্মেন্ট অর্ডারে (জিও) প্রথমে স্বাক্ষর করেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন কিশোরগঞ্জ থেকে রাতে ফিরে তাতে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি। প্রশ্ন ওঠেছে গুরুতর এসব অভিযোগ জানার পরেও কিভাবে জিও জারি করা হলো। তাহলে কি এসব অভিযোগ জানা সত্ত্বেও সরকার বিষয়টি গোপন রেখেছে?

গতকাল রোববার আইন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকরা আইনমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, অভিযোগ থাকলে সেটা মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াতে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। তাকে বিদেশে যেতে দেয়ায় কোন অনিয়ম বা নীতিগত সমস্যা হয়নি।

তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি পদটি একটি প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক পদ। ফলে তার বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো বা খামখেয়ালি করে কিছু করা সমীচীন হবে না।

আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে যে ১১টি অভিযোগ উঠেছে তার অনুসন্ধান হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে অভিযোগগুলোর তদন্তের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই দুর্নীতি দমন কমিশনের আওতায়। তাহলে আপনারা বুঝতেই পারছেন, কে এটার অনুসন্ধান করবে। অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া গেলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

গত শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে লিখিত বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধু রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে। এই বিবৃতির দুইদিন আগে গত বুধবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক রদবলের কথা গণমাধ্যমকে জানান। ওই দিন বিকেল ৩টা থেকে ৩টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার খাস কামরায় বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ চেঞ্জ (প্রশাসনিক পরিবর্তন) করতে চান, সেগুলো উনি আমাকে অবহিত করেছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এই বক্তব্যের পর গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করেছে সরকার। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, রেজিস্ট্রার ও প্রধান বিচারপতির সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একান্ত সচিবসহ ১০ কর্মকর্তাকে বদলি করে রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। এর আগে দুপুরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়া রদবদলে অনুমোদন দেন।

সুপ্রিম কোর্টে ব্যাপক রদবদল

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল, রেজিস্ট্রার ও প্রধান বিচারপতির একান্ত সচিবসহ ১০ কর্মকর্তাকে বদলির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। অনুমোদন দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির পর এটি কার্যকর হওয়ার কথা।

গতকাল রোববার দুপুরের দিকে প্রধান বিচারপতি (ভারপ্রাপ্ত) মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার অনুমোদনের পর তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারির করে।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অফিস সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন আদালতে তাদের বদলির জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ এম আমিনুল ইসলামকে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজকে লালমনিরহাটের অতিরিক্ত জেলা জজ, আনিসুর রহমানকে পঞ্চগড় জেলার অতিরিক্ত জেলা জজ, যাবিদ হোসাইনকে রংপুরের নারী-শিশু ট্রাইব্যুনালের বিচারক, রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনকে ঢাকার স্পেশাল জজ, অরুণাভ চক্রবর্তীকে সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা জজ, ফারজানা ইয়াসমিনকে পিরোজপুরের যুগ্ম জেলা জজ, কামাল হোসেন শিকদারকে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত জেলা জজ, আজিজুল হককে ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত জেলা জজ এবং এইচ এম ইসমাঈলকে বরগুনাতে বদলি করা হয়েছে।

ফুলকোর্ট সভা আজ

এদিকে আজ সোমবার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা আজ সোমবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছেন। গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন ও বিচার) মো. আজিজুল হক স্বাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামীকাল বিকেল চারটায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণের অংশগ্রহণে অত্র কোর্টের জাজেজ লাউঞ্জে ফুলকোর্ট সভা অনুষ্ঠিত হবে।

গত ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার প্রথম দিনেও ফুলকোর্ট সভা বসেছিল। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রমও শুরু হয়েছিল ওই দিন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে প্রথম ফুলকোর্ট সভায় ওইদিন বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও সমুন্নত রাখতে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের সব বিচারপতিকে সময়মতো আদালতে আসা ও এজলাসে বসার আহ্বান জানান। তাছাড়া বিভিন্ন মামলায় দেয়া রায় তাড়াতাড়ি লিখতেও তিনি বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানান।

http://www.dailysangram.com/post/303725