১৬ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫০

মরণখেলা ব্লু হোয়েলে ঢুকলে বেরোনো যায় না

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : ইন্টারনেট বা অনলাইন কেন্দ্রিক খেলা। নাম ‘ব্লু হোয়েল’ বা নীল তিমি। খেলা নয়, মৃত্যুফাঁদ বললেও অত্যুক্তি হয় না। হ্যাঁ, একদম মৃত্যুফাঁদই। তবে এর লিংক গুগল বা ফেসবুকে পাওয়া যায় না। বিশেষ কন্টাক্ট থেকে জোগাড় করতে হয়। এ খেলায় যে একবার ঢোকে, তার মৃত্যু ছাড়া মুক্ত হবার আর নাকি কোনও উপায়ই থাকে না। এমনই এক জীবনবিনাশী খেলা এটি। এ নিয়ে এখন আতঙ্কিত বহু দেশের অভিভাবকমহল। আমরাও ব্লু হোয়েলের দুর্লঙ্ঘ বলয়ে আটকা পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আর এটা সত্যি হলে দুর্ভাবনাই বটে!

না, বাংলাদেশে একজনের আত্মহত্যা নয়। দেশে এ পর্যন্ত ৬১ জন কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েলের ছোবলে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে। আক্রান্তের সংখ্যা নিশ্চয় অনেক। অবিলম্বে দৃঢ় পদক্ষেপ না নিতে পারলে পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হতে পারে।
ঘটনাটি খুলেই বলি: শাহবাগের দিক যাচ্ছিলেন এক বাসযাত্রী গত ৬ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায়। পাশে বসা আরেক যাত্রী বারবার সেলফোনে কথা বলছেন আর বিভিন্ন জনকে ব্লু হোয়েল গেমের কথা জানাচ্ছেন। কৌতূহলবশত যাত্রীটি জিজ্ঞাসা করলেন, ঘটনা কী?

পাশে বসা ভদ্রলোক জানান, তার ভাইয়ের মেয়ে গত ৪ অক্টোবর বুধবার রাতে আত্মহত্যা করেছে। মেয়েটি হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। রোল ছিল এক। অর্থাৎ খুব মেধাবী ছিল মেয়েটি। নাম অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। অতীতের ক্লাসগুলোতেও মেয়েটির রোল এক নম্বরই ছিল বলে জানা যায়। স্বর্ণার কাকা জানান, আত্মহত্যার পর দেখা যায় তার শরীরে নীল তিমি আঁকানো। মেয়েটির ছবিও দেখালেন তিনি। অনেক হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার মেয়ে স্বর্ণা। মায়াভরা দৃষ্টি। এমন মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে কেন নিলো ভাবতেও কষ্ট হয়!

বিশ্বের বহু দেশে ব্লু হোয়েল খেলতে খেলতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে তরুণ-তরুণীরা কয়েক বছর যাবৎ। বাংলাদেশেও এর বিস্তার ঘটছে। অপূর্বাসহ ৬১ জনের মৃত্যু নেহায়েত কম নয়। এরপর আরও নিশ্চিত হবার জন্য হলিক্রস স্কুলের কেউ আত্মহত্যা করেছে কি না, তা জানতে গুগলে সার্চ করা হয়।
পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে বৃহস্পতিবার সকালে মেয়েটি মারা যায়। রিপোর্টে আত্মহত্যা ও মোবাইল এপসের কথা উল্লেখ থাকলেও অবশ্য মেয়েটির শরীরে নীল তিমি আঁকবার তথ্যটি নেই। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার হয়তো সে তথ্য পাননি।
ব্লু হোয়েল অনলাইন সুইসাইড গেম। এর ফাঁদে পড়ে সারা বিশ্বে শতশত টিনএজার আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। গেমটি কোথাও ডাউনলোড করে পাওয়া যায় না। তবে বিশেষভাবে গেমটির কিউরেটর বা এডমিনিস্ট্রেটরের নজরে আসা যায়। এরপর কিউরেটর বা এডমিনিস্ট্রেটর নিজেই যোগাযোগ করে গেমের অংশ হিসেবে প্রতিযোগীকে একেক দিন একেকটি চ্যালেঞ্জ টাস্ক দেন। এভাবে পঞ্চাশ দিনের মোট পঞ্চাশটি চ্যালেঞ্জ পূরণ করতে হয় গেমটি শেষ করবার জন্য। চ্যালেঞ্জগুলোও অনেক অদ্ভুত। যেমন: হাত কেটে কিছু লেখা, চাকু দিয়ে শরীরে তিমি মাছ আঁকানো, উঁচু বিল্ডিংয়ে চড়া, মাঝরাতে কবরস্থানে যাওয়া, শরীরে সুই ফোটানো, ব্লেড দিয়ে শরীরের কোনও অংশ কেটে দেয়া, ভোর রাতে বাইরে বের হয়ে যাওয়া, গায়ে আগুন লাগানো ইত্যাদি।

প্রত্যেক চ্যালেঞ্জ শেষ করবার পর এর ছবি আবার এডমিনিস্ট্রেটরকে পাঠাতে হয় প্রমাণ দেবার জন্য। তখন এডমিনিস্ট্রেটর তার সাহসিকতার প্রশংসা করে তাকে পয়েন্ট দেন। এভাবে ঊনপঞ্চাশটি চ্যালেঞ্জ শেষ করবার পর সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ দেয়া হয় সুইসাইড বা আত্মহত্যা করতে। আর এ চ্যালেঞ্জটিই বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এপর্যন্ত সারাবিশ্বে কয়েকশত টিনএজার আত্মহত্যা করেছে। প্রতিবেশী ভারতেও ১৩০ জন তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছে এ গেম খেলে। রাশিয়াতে মারা গেছে ১৮১ জন। কেউ যদি গেমটি শুরু করবার পর আর না খেলতে চায়, তখন তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয় তার অথবা আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতি করবার। যদিও এসব হুমকির কোনও বাস্তবতা নেই, কিন্তু অনেক টিনেজার এগুলো হুমকিকেই সত্যি ভেবে ভয় পেয়ে গেমটা চালিয়ে যায়।

রাশিয়ার ‘ডেথ গ্রুপ’ নামের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপ গেমটি চালায়। এ গেমটি ২০১৩ সালে রাশিয়ার ফিলিপ বুদেকিন নামের একজন মনোবিজ্ঞানের ছাত্র তৈরি করেন। সম্প্রতি রাশিয়ার পুলিশ ফিলিপকে গ্রেফতার করবার পর এ ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আট থেকে বাইশ বছর পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীরা এ গেমে এডিক্ট হয়। এদের মধ্যে টিনেজার বেশি আত্মহত্যা করেছে। তাই নিজের কাছের কিশোর-কিশোরীদের দিকে নজর রাখা উচিত সবসময়। কেউ এ গেমের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে কি না কিংবা কেউ কোনও অস্বাভাবিক আচরণ করছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এমন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে অবশ্যই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। অন্যথায় ওদের নীল তিমির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তুখোড় মেধাবী ছাত্রী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার বয়স মাত্র তের। হলিক্রস স্কুলে ভর্তির পর থেকেই মেয়েটি বদলে যেতে থাকে। পড়াশোনার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে। ফেসবুকসহ সোসাল মিডিয়ার ব্যবহার চলছিল। এর মধ্যে সবার অজ্ঞাতেই ইন্টারনেটের এক নিষিদ্ধ গেম ব্লু হোয়েলে ঢুকে পড়ে মেয়েটি। ওর পিতারও সন্দেহ হয়েছিল এমনই কিছু একটা। দুঃখজনকভাবে অভিভাবকদের অজান্তেই মেয়েটি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ৫ অক্টোবর নিউমার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নং বাসার বি-৫ থেকে ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চিরকুটে সে লিখে যায় যে, ব্লু হোয়েলের কিউরেটরের নির্দেশ মোতাবেক সে আত্মহত্যা করেছে। এর জন্য কেউ দায়ী নন। চিরকুটে একটি হাসির চিহ্ন আঁকানো ছিল।

ইন্টারনেট তথা ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যেমন ভালো দিক আছে, তেমনই খারাপ দিকও আছে। এগুলোর ব্যবহার এযুগে যেমন জরুরি, তেমনই কিছু বিপদও রয়েছে। তবে বিচার, বুদ্ধি ও বিবেক খাটিয়ে এগুলোর ব্যবহার করতে হবে। কোনওকিছুরই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার ঠিক নয়। এতে হিতে বিপরীত হবার আশঙ্কা থাকে। বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যেমন: এলকোহল। এর অতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতির কারণ ঘটায়। কিন্তু এটি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। সাপের বিষ ব্যবহার করে মানুষকে মেরে ফেলা যেতে পারে। আবার এ থেকে জরুরি ওষুধও প্রস্তুত হয়, যা মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যবহৃত হয়। কাজেই সবকিছুরই ভালো ও মন্দ দিক আছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে পৃথিবী আজকাল অচল। তবে এর অপব্যবহার জীবনবিনাশী হতে পারে। ধ্বংসাত্মক হয়ে পড়তে পারে। ব্লু হোয়েল গেম তার ভয়াবহ উদাহরণ। কাজেই এমন বিনাশী খেলা যাতে আমাদের তরুণ-তরুণীরা না খেলে সেদিকে অভিভাবকদের নজর দিতে হবে। মরণখেলা ব্লু হোয়েলের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে। এ উদ্যোগ নিশ্চয় আশাব্যঞ্জক।

http://www.dailysangram.com/post/303673