১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:১৩

মাটি কামড়ে থাকা রোহিঙ্গারা পাঠাচ্ছে ভয়াবহ সব তথ্য

রাজধানীতে বসে মিয়ামারের নেত্রী অং সান সু চি রাখাইন পরিস্থিতি শান্ত করতে যেসব উদ্যোগের কথা বলছেন, এর কোনো প্রতিফলন নেই রাখাইনে। এখনো হত্যাকাণ্ড চলছে।

নারী-শিশু সবাই সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সেনাদের বুটের আঘাতে শিশু রক্তাক্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা পাড়ায় লুটপাট চালিয়ে নৌকায় করে লুটের মাল নিয়ে যাওয়া হয়। চলতি সপ্তাহেই দেশটির সেনাপ্রধান দাবি করেছেন, রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি’। সেনাবাহিনী দৃশ্যত এই নীতি থেকেই রোহিঙ্গা নির্মূলের সব অপতত্পরতা চালাচ্ছে রাখাইনে। বৃহস্পতিবার মংডুতে এসেছেন চরমপন্থী বৌদ্ধ নেতা অশিন উইরাথু। রোহিঙ্গারা বলছে, সেনাবাহিনীর চাওয়া ও কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের চাওয়া যে একই এর প্রমাণ হচ্ছে অশিনের এই সফর। মিয়ানমারের মংডু, বুচিদং ও রাথিডং এলাকায় এখনো অবস্থান করছে, এমন সাতজন বাসিন্দা কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে জানায়, মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।
গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত তিন দিন কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে রাখাইনে এখনো অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

একই সঙ্গে রাখাইনের রোহিঙ্গা পাড়ায় অবস্থানরতদের মাধ্যমে একাধিক স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র ধারণ করে সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত এসব স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্র ধারণকারীদের নাম, পরিচয় ও ছবি কালের কণ্ঠ’র এ প্রতিবেদকের কাছে আছে। তবে তথ্যদাতাদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের বিস্তারিত পরিচয় এই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়নি।
মংডু, বুচিদং ও রাথিডংয়ের বাসিন্দাদের দাবি, সেনাপ্রধানের দাবি বাস্তবায়ন করতেই বৃহস্পতিবার মংডুতে বৌদ্ধ নেতা অশিন উইরাথু এসেছেন। তিনি হিন্দুদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং রাখাইন পরিস্থিতির জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করেছেন। এ ছাড়া উইরাথু বৌদ্ধদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বলে রোহিঙ্গারা জানিয়েছে। রোহিঙ্গারা বলছে, বিশ্ব সম্প্রদায়ের দাবির মুখে মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চি বক্তব্য দিয়ে যা দাবি করছেন, এর ছিটেফোঁটাও যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে রোহিঙ্গাদের এখনো বাংলাদেশমুখী পলায়নরত থাকতে হতো না। তারা সন্ধ্যা ৬টার মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে। ভোরের আগে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। কারফিউ বলবৎ রেখেছে সরকার। রাতের অন্ধকারে সেনারা এখনো পাড়ায় পাড়ায় এসে ধর্ষণ, নির্যাতন চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বুথিডংয়ের হাচপ্রাং এলাকায় আবদুর রহমানকে (৩৮) গুলি করে হত্যা করেছে মিলিটারি। নিহতের একটি ছবিও কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। পাঁচ সন্তানের জনক আবদুর রহমান নিজ ঘরে চাল না থাকায় বোনের ঘরে চালের জন্য যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাঁকে গুলি করে মিলিটারি। এমনটাই দাবি করে প্রত্যক্ষদর্শী এক রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গার ঢল যখন চলছে, তখনো কোন ভরসায় নিজেদের দেশে রয়ে যাচ্ছে—জানতে চাইলে বুচিদং ও রাথিডং এলাকার বাসিন্দারা জানায়, রোহিঙ্গাদের পক্ষে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংস্থা ও বিশ্বের বেশির ভাগ পরাশক্তি কথা বলছে। রবিবার মিয়ানমারের রাজধানীতেও সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে বিদেশি প্রতিনিধিদের বৈঠক হওয়ার কথা তাদের কানে এসেছে। ওই বৈঠকের ফলাফলের দিকে অনেকেই তাকিয়ে আছে। যদি ইতিবাচক কোনো পরির্তন না হয়, তাহলে অবশিষ্ট রোহিঙ্গারাও জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশমুখী হতে পারে। বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে পরদেশি জীবন বরণ করতে রাজি নয় উল্লেখ করে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা জানায়, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জন্মভিটায় থাকতে চায় তারা।

রাখাইন থেকে পাওয়া একাধিক ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, রাখাইনে কিছু রোহিঙ্গা পাড়া এখনো অক্ষত রয়েছে। তবে সেগুলো প্রায় জনবসতিহীন। বাজারেও লোকজন কম, অধিকাংশ দোকান বন্ধ। স্বল্পসংখ্যক দোকান খোলা থাকলেও সেখানে প্রাণচাঞ্চল্য নেই। কয়েকটি শিশু ও হাতে গোনা কয়েকজন বয়স্ক লোক দেখা গেছে বাজারে।

বুথিডং রোহিঙ্গা পাড়া থেকে সংগৃহীত স্থিরচিত্র ও ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, পাড়া বলতে কিছু ঝুপড়ি ধরনের কাঁচা ঘর। কিছু ঘর তক্তা দিয়ে তৈরি। ছন বা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোতে যাতায়াতের পথচিত্র বুঝে নিতে হয়। অবকাঠামোগতভাবে ইটের সলিং কিংবা পাকা কোনো সড়ক দেখা যায়নি। হাঁটার পথ কর্দমাক্ত। সেখানে কয়েক টুকরো কাঠ ফেলে রাখা হয়েছে। পাড়ার অধিকাংশ ঘরের দরজা বন্ধ, জনমানব নেই।

এমন একটি জনমানবহীন পাড়ায় দেখা গেছে, দুজন রাখাইন যুবক হেঁটে যাচ্ছে। তাদের পিঠে বিশেষ ধরনের ব্যাগে হাতিয়ার আছে বলে দাবি রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গা যুবক দেখলেই আক্রমণ করে রাখাইনরা। অন্য একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। দূর থেকে ভিডিও ধারণকারী রোহিঙ্গা যুবকের দাবি, যারা গরু নিয়ে যাচ্ছে তারা সবাই রাখাইন যুবক। আর গরুগুলো রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া। এসব গরু মিলিটারি ও রাখাইন যুবকরা পাড়া থেকে লুট করে নিয়েছে। জুলাই মাসেও যে গরুর দাম ছিল আট-দশ লাখ কিয়াত, এখন সেসব গরু লুটের পর রাখাইনরা বিক্রি করছে দেড় দুই লাখ কিয়াত দামে।

বুথিডংয়ের টম বাজারে যাওয়ার পথে একটি নদী আছে। ওই নদীপথে টম বাজার, লংসং ও নাক্ষ্যংদাং এলাকায়ও যাওয়া যায়। ওই নদী থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় ধারণ করা একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, একটি ইঞ্জিন নৌকা বিকট শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখায় যায়, নৌকাটি মালে বোঝাই। নৌকায় কয়েকজন আরোহী। ভিডিও চিত্র ধারণকারী ব্যক্তি ও সেখানকার বাসিন্দা আবদুল মজিদের ভাষ্য অনুযায়ী, আরোহীরা সবাই রাখাইন যুবক এবং তারা রোহিঙ্গা পাড়া থেকে মালপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েকবার এমন মালবাহী নৌকা যেতে দেখা যায় আজকাল। ওই রোহিঙ্গার আরো দাবি, পাড়াগুলো খালি হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে রোহিঙ্গাদের মূল্যবান সম্পদ পড়ে ছিল। এর মধ্যে চাল, ডাল, ধান, গরু, আলু, মরিচ ইত্যাদি এখন লুটের মালে পরিণত হয়েছে। লুটের পর নৌকায় ভর্তি করে টম বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেয় রাখাইনরা।

১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে বুথিডং থেকে বাংলাদেশমুখী এক দল রোহিঙ্গাকে তাড়া করে মিয়ানমার বাহিনী। তাড়া খেয়ে বয়স্করা পালিয়ে যেতে পারলেও এক শিশুকে ধরে ফেলে সেনারা। পরে ওই শিশুকে বুটের লাথি মেরে ফেলে যায়। এই সময় রোহিঙ্গা শিশুটি রক্তাক্ত জখম হয়। শিশুর রক্তাক্ত জখম হওয়ার একটি ছবি ধারণ করে পাঠিয়েছেন বুথিডং এলাকার দেট মিন চং গ্রামের বাসিন্দা নাছির উদ্দীন।

বুথিডংয়ের একটি পাড়ার বাসিন্দা করিম জানান, পাড়ায় এখনো যেসব ঘর পোড়ানো হয়নি, সেগুলোর বাইরের বেড়া খুলে ফেলতে হয়েছে সেনাদের নির্দেশনায়। কয়েকটি দোতলা বাড়ির নিচের তলার সব বেড়াও খুলে ফেলতে হয়। রাথিডং এলাকায় এখন মাত্র পাঁচটি পাড়া অক্ষত আছে বলে জানিয়েছেন করিম।

বুচিদং এলাকায় মোহাম্মদ আলীর মার্কেট নামে একটি বাজার আছে। দুই শতাধিক দোকান নিয়ে বাজারটি প্রতিষ্ঠিত। এই বাজারে নিয়মিত রোহিঙ্গারা বাজার করে। শুক্রবার বিকেলে ধারণ করা এক ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, বাজারে হাতে গোনা কিছু লোক। বেশির ভাগই শিশু। বয়স্ক লোকজন কম। অধিকাংশ দোকান বন্ধ। ভিডিও ধারণকারী রহমান উল্লাহর দাবি, এই বাজারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ও রাখাইন একসময় বাজার করত। এখন বাজারে শিশু ছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিরা আসে না। কারণ রাখাইন যুবকরা বয়স্ক রোহিঙ্গা দেখলেই আক্রমণ করে। রাখাইনদের দৌরাত্ম্য এখনো থামেনি। শনিবার সকালেও বাজারে রোহিঙ্গা যুবক হান্নান উল্লাহকে পিটিয়ে জখম করা হয়েছে জানিয়ে রহমান উল্লাহ জানান, প্রতিদিনই হামলা হয়। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/10/15/553809