১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:০৮

সাগরে মাছ ও প্রাণী বিপন্ন

চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া-জলবায়ু ও দূষণে খাদ্য-শৃঙ্খল বিচরণের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত -বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বিদেশী নৌযানে মৎস্যসম্পদ লোপাট
‘মৎস্য খনি’ বঙ্গোপসাগরে অর্থকরী মাছ এবং বিভিন্ন প্রাণী বিপন্ন প্রায়। জেলেদের জালে আগের তুলনায় মাছ ধরা পড়ছে কম হারে। বেশিদিন সাগরে ট্রিপ দিয়েও অল্পস্বল্প মাছ নিয়ে পোতাশ্রয়ে ফিরতে হচ্ছে অনেকটা হতাশ হয়ে। হাজারো জেলে মাঝি-মাল্লা বেকার অথবা অর্ধ-বেকার অবস্থায় দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মজুদ ও স্বাভাবিক বিচরণশীলতা কমে এসেছে। বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদ বা বিচরণ, স্থিতি নিরূপণের জন্য নিবিড় বৈজ্ঞানিক জরিপ কার্যক্রম দীর্ঘ ২৮ বছর পর হাতে নেয়া হলেও জরিপ জাহাজ ‘এম ভি মীনসন্ধানী’র যুগোপযোগী সক্ষমতার ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে এই প্রক্রিয়া আটকে গেছে। সাগরপাড়ের বন্দরনগরী চট্টগ্রামেই এখন মাছের জোগান কমতির দিকে। রসনাবিলাসী সামুদ্রিক দামও আকাশছোঁয়া। কোরাল, লাক্ষ্যা, টুনা, চিংড়ি, পোয়া, সুরমার মতো অনেক সুস্বাদু জাতের মাছ বাজারে কমই পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। খামারে উৎপাদিত মাছে ভরে গেছে বাজার। দামে তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা সেদিকেই ঝুঁকছেন। সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি শুঁটকির মূল্য অবিশ্বাস্য গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সামুদ্রিক বিশেষজ্ঞদের মতে, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া-জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমুদ্রসম্পদের উপর। তাছাড়া অবিরাম দূষণের কবলে রয়েছে সমুদ্র। এতে করে সাগরে মৎস্যসম্পদ ও প্রাণিকুলের খাদ্য-শৃঙ্খল (ফুড চেইন), বিচরণক্ষেত্রের পরিবেশ হচ্ছে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেই সাথে ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, মিয়ানমার, ফিলিপিনোসহ বিদেশী অনুপ্রবেশকারী ট্রলার-নৌযানের মাধ্যমে চুরি করে মৎস্যসম্পদ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে মাছ শিকারের কারণেও সামুদ্রিক মাছের বর্ধনশীলতা, বিচরণ, প্রজনন এমনকি অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তীর্ণ পানিসীমা এবং ২শ’ নটিক্যাল মাইল মহিসোপান নিয়ে একান্ত অর্থনৈতিক জোন (ইইজেড) মূল্যবান মৎস্যসম্পদের ভান্ডার। যা ষাটের দশকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বিজ্ঞানীরা ‘মৎস্য খনি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্স এন্ড ফিশারিজের প্রফেসর ড. হোসেন জামাল গতকাল (শনিবার) ইনকিলাবকে জানান, চরমভাবাপন্ন জলবায়ুর প্রভাব এবং বিভিন্নমুখী দূষণের কারণে সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সাগরের পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবীভূত হয়ে ক্ষতিকর কার্বলিক অ্যাসিড তৈরি হচ্ছে। এ কারণে মাছের স্বাভাবিক বিচরণশীলতা ও খাদ্য প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। সহনশীল তাপমাত্রা হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ হয় বিপন্ন, বিলুপ্ত অথবা অন্যত্র সাগর-মহাসাগরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। যেমন- কোরাল মাছ বিøচিং বা সাদাটে হয়ে অস্তিত্ব হারানোর উপক্রম হচ্ছে। তিনি জানান, প্রকৃতির আপন নিয়মে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সাগরের পানির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে বা লেয়ারে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে অসহনশীল ও একই স্তরে এসে যেতে গিয়ে বিপন্ন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাছাড়া সমুদ্রে ঘন ঘন বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করার কারণে মাছ শিকারে ঝুঁকি ও খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ড. জামাল আরও জানান, সাগরে দূষণের বহুমুখী বিরূপ প্রভাবের শিকার হচ্ছে মৎস্যসম্পদ ও প্রাণিকুল। বিশেষত জাহাজের বর্জ্য ও পোড়া তেল দূষণের কারণে সাগরের পানিতে মাছের জন্য জরুরি সূর্যালোক প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাছের খাদ্য তৈরির শৃঙ্খল (ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটন) নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া সাগরে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ও আবর্জনা প্লাস্টিকের বোতল প্রভৃতি নিক্ষেপের কারণে মাছসহ প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠছে। এর পরিণতিতে সাগরের মৎস্যক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর মাছের মজুদ, উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে।
আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তনের সক্রিয় বিরূপ প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের উদ্ভিদ, মাছসহ প্রাণীজগৎ ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাবার ও বাসস্থানের উপযোগী পরিবেশ না পেয়ে গভীর সাগরের মাছ ও প্রাণীরা বেঘোরে মারা পড়ছে। বঙ্গোপসাগরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপতার কারণে সমুদ্রের উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে পরিবর্তন ঘটতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে দেশের একমাত্র কোরালরীফ সেন্টমার্টিন দ্বীপের উপর। ড. হোসেন জামাল সম্প্রতি সেন্টমার্টিন সরেজমিনে পরিদর্শনের কথা জানিয়ে সেখানকার বিপন্ন ও অরক্ষিত অবস্থায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়িসহ ৪৭৬ প্রজাতির মাছ মজুদ রয়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক ষাটের দশকে বঙ্গোপসাগরে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ জরিপ-গবেষণায় জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা মাছসহ সামুদ্রিক সম্পদে সুসমৃদ্ধ। সাগরে মূল ৩টি মৎস্য বিচরণ এলাকা হচ্ছে ‘সাউথ প্যাসেচ’, ‘মিডলিং’ বা ‘মিডল গ্রাউন্ড’ এবং ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’। সেখানে মজুদ ও বিচরণশীল রয়েছে রুপচান্দা, কালাচান্দা, কোরাল, ইলিশ, লাক্ষা, ছুরি, পোয়া, লইট্টা, মাইট্টা, চিংড়ি ও টুনাসহ হরেক প্রজাতির অর্থকরী মাছ। অগভীর অংশে মাছ বেশিহারে ধরা হলেও গভীর সমুদ্রের দিকের মাছ (টুনা জাতীয়) কম আহরণ হচ্ছে। এতে করে সাগরে মাছের ভারসাম্যহানি ঘটছে।

১৯৫৮ সালে জাপানি গবেষণা ও সমুদ্র অনুসন্ধানী জাহাজ ‘খুশি মারো’ যোগে প্রথম জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এরপর ১৯৬০ সালে ‘কাগাওয়া মারো’ থেকে শুরু করে ১৯৮৪-৮৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আর্থিক সহায়তায় ‘অনুসন্ধানী’ নামক জরিপ জাহাজে বাংলাদেশের সন্নিহিত বঙ্গোপসাগরে বিশাল মৎস্য ভান্ডারের মজুদ, স্থিতি ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নিরূপন করা হয়। গবেষণা জাহাজযোগে এসব জরিপে বেরিয়ে এসেছে, চিংড়ি, ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছে ভরপুর বঙ্গোপসাগর। এটি মাছের বংশ বৃদ্ধি ও দ্রুত বর্ধনের উর্বর ক্ষেত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া মাছ শিকার নিয়ন্ত্রণ, পোনা নিধন বন্ধ, পরিবেশ দূষণ রোধ, মাছের বিচরণ এলাকা বা অভয়াশ্রম সংরক্ষণ করা হলে বাংলাদেশ শুধুই তার সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ দিয়েই সবল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/99898/