১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:০৬

সুপ্রিমকোর্টের বিবৃতি

সিনহার বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগ

বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ অভিযোগগুলো আপিল বিভাগের চার বিচারপতির কাছে তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি * প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার প্রদান * একই বেঞ্চে বসতে চাননি ৫ বিচারপতি * এসকে সিনহার লিখিত বিবৃতি বিভ্রান্তিমূলক
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ উঠেছে। ৩০ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বঙ্গভবনে ডেকে এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণাদি হস্তান্তর করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

শনিবার সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার সৈয়দ আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষর করা দুই পৃষ্ঠার বিবৃতিতে জানানো হয়েছে এসব তথ্য।
এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার ফিরে এসে দায়িত্ব গ্রহণ সুদূর পরাহত। কারণ, আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তার সঙ্গে এক বেঞ্চে বসতে চান না। অন্য বিচাপতিরা না বসলে এসকে সিনহা একা বিচারকাজ করতে পারবেন না।

অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে শুক্রবার রাতে এসকে সিনহা বলেছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন। তবে বাস্তবতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসকে সিনহা ফিরে এলেও প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সমালোচনার মধ্যে সংসদে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে। এবার তার সহকর্মীদের মধ্য থেকেও একই অভিযোগ এলো।

সুপ্রিমকোর্টের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনের দায়িত্ব প্রদান করেন।’ এতে বলা হয়, ‘প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সুমন্নত রাখার স্বার্থে ইতিপূর্বে সুপ্রিমকোর্টের তরফ থেকে কোনো প্রকার বিবৃতি বা বক্তব্য প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে উক্ত বিবৃতি প্রদান করা হল।’
শুক্রবার রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার লিখিত বিবৃতির জবাবে সুপ্রিমকোর্টের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, এসকে সিনহার বিবৃতি বিভ্রান্তমূলক। এতে বলা হয়, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ব্যতীত আপিল বিভাগের ৫ জন বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান। বিচারপতি মো. ইমান আলী দেশের বাইরে থাকায় তিনি সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। অপর চারজন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনার একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংবলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তর করেন। এর মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।’

সুপ্রিমকোর্টের ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘বিচারপতি ইমান আলী ঢাকায় আসার পর ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের ৫ বিচারপতি বৈঠকে মিলিত হয়ে উক্ত ১১টি অভিযোগ বিশদভাবে পর্যালোচনার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ওইসব গুরুতর অভিযোগগুলো প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে অবহিত করা হবে। তিনি যদি ওইসব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক জবাব বা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন তাহলে তার সঙ্গে বিচারালয়ে বসে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ সিদ্ধান্তের পর ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টায় মাননীয় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অনুমতি নিয়ে উল্লিখিত পাঁচ বিচারপতি মাননীয় প্রধান বিচারপতির ১৯ হেয়ার রোড, রমনা, ঢাকার বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পরও তার কাছ থেকে কোনো ধরনের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর না পেয়ে আপিল বিভাগের উল্লিখিত ৫ বিচারপতি তাকে সুস্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, এ অবস্থায় উক্ত অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাদের পক্ষে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সুস্পষ্টভাবে বলেন, সে ক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে ২ অক্টোবর তিনি উল্লিখিত বিচাপতিদের কোনোকিছু অবহিত না করেই মাহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির আবেদন করেন এবং রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনের দায়িত্ব প্রদান করেন।
সুপ্রিমকোর্টের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ‘ছুটি ভোগরত প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ১৩ অক্টোবর বিদেশ গমনের প্রাক্কালে একটি লিখিত বিবৃতি গণমাধ্যম কর্মীদের হস্তান্তর করেন। উক্ত বিবৃতি সুপ্রিমকোর্টের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উক্ত লিখিত বিবৃতি বিভ্রান্তিমূলক।’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সুপ্রিমকোর্টের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। শনিবার বিকালে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলামের স্বাক্ষরে বিবৃতিটি দেয়ার আগে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে বৈঠক করেন বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
গত শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গণমাধ্যমের সামনে বলেন, ‘আমি অসুস্থ না। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগটা যাতে কলুষিত না হয়, এ কারণেই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারও প্রতি কোনো বিরাগ নেই। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই আমার বক্তব্য। আর কিছু বলব না।’ ওই সময়ে একটি লিখিত বক্তব্য প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের পরিবেশন করেন। পরে রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।

প্রসঙ্গত, সুপ্রিমকোর্টের ২৫ দিনের অবকাশ শেষে প্রথম কার্যদিবস ছিল ৩ অক্টোবর। কিন্তু অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ২ অক্টোবর এক মাসের (৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত) ছুটি চেয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে চিঠি পাঠান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। রাষ্ট্রপতি ওই ছুটি মঞ্জুরও করেন। পরে বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সরকারি আদেশের (জিও) প্রসঙ্গ এলে গত মঙ্গলবার এসকে সিনহা রাষ্ট্রপতিকে জানান, তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে চান। বিষয়টি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই দিন সাংবাদিকদের জানান, প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যেতে চান। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনেও উল্লেখ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, বর্ধিত ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়, অর্থাৎ ২ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এসকে সিনহা আগামী ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাবেন।
তার ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সিনিয়র নেতারা এবং বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, প্রধান বিচারপতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকার জোর করে তাকে ছুটি দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছে। শুক্রবারও এ নিয়ে দিনভর সরব ছিল মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেয়া সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেয়ার পর থেকে বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব সংসদে পাস হয়, যা ষোড়শ সংশোধনী হিসেবে পরিচিত। নয়জন আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ৫ মে সংবিধানের ওই সংশোধনী ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে রায় দেন। গত ৩ জুলাই আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় ১ আগস্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণের এক স্থানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানবাধিকার ঝুঁকিতে, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত, সংসদ অকার্যকর, কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত।’ ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সামরিক শাসন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে।

এরপরই প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া রায় ও পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। পাশাপাশি রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া পর্যবেক্ষণও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিচারপতি সিনহার ভাইয়ের নামে রাজউকের প্লট নেয়ায় অনিয়মের কথা সংসদে বলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথাও বলেছিলেন তিনি। সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মালিকানাধীন ব্যাংকে বেনামে বিচারপতি সিনহার অর্থ জমা রাখার কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ‘দুর্নীতির’ তদন্ত আটকাতে প্রধান বিচারপতি সিনহার পদক্ষেপের সমালোচনা করেন। শনিবার সাবেক আইনমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল মতিন খসরু কুমিল্লায় তার নির্বাচনী এলাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বিরুদ্ধে দালিলিক প্রমাণসহ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্তে তা প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/15/163407