১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১২:০০

তিন টাকার ডিম কেনা হল না

বদরুদ্দীন উমর

১৩ অক্টোবর ছিল ‘বিশ্ব ডিম দিবস’। এই বিশেষ দিবসে সস্তায় তিন টাকা দরে এক একটি ডিম বিক্রির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ও সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এই ডিম বিক্রির জায়গা ছিল ঢাকার খামারবাড়ী কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন। সাধারণ ডিমের বাজারদর এখন ৩২ টাকা হালি অর্থাৎ প্রতিটি ডিম ৮ টাকা। এছাড়া সম্পূর্ণ ভেজালবর্জিত নিরাপদ ঘোষিত এক ডজন ডিমের এক প্যাকের দাম ১৪০ টাকা অর্থাৎ প্রতিটি ডিম ১১ টাকার ওপর। এ অবস্থায় তিন টাকা দরে ডিম বিক্রির ঘোষণা সাধারণ ক্রেতাদের অনেকের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বলা হয়, এক একজন সর্বোচ্চ ৯০টি ডিম কিনতে পারবেন। শুক্রবার সকাল ১০টায় ডিম বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও উপচে পড়া ক্রেতার সংখ্যার দিকে তাকিয়ে তা শুরু করা হয় সাড়ে ৯টার দিকে।

ডিম বিক্রি শুরুর পর প্রথমে ৩০টি ও পরে ২০টি করে ডিম এক একজন ক্রেতাকে বিক্রি করতে থাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজকরা ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেন। কেন তারা এ কাজ করলেন এর কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। কারণ, বিপিআইসিসির সভাপতি যুগান্তরকে (যুগান্তর ১৪.১০.২০১৭) বলেছেন, ৫০ হাজার ডিম বিক্রির কথা থাকলেও তারা এক লাখ ডিম নিয়ে এসেছিলেন বিক্রির জায়গায়। আয়োজকদের কথা হল, ভিড়ের চাপে তারা ডিম বিক্রি বন্ধ করেন। রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, খামারবাড়ী থেকে একদিকে বিজয় সরণি এবং অন্যদিকে ফার্মগেট পর্যন্ত লাইন ছিল। লাইন দিয়েই মানুষ ডিম কেনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। কাজেই সেখানে তো এমন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা নয়। যদি সত্যিই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দ্বারাই এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে তা সামাল দেয়ার ব্যবস্থা এমন অসম্ভব কীভাবে হল যে ডিম বিক্রি বন্ধ করতে হল?

জিনিসপত্রের মূল্য, বিশেষত খাদ্যের মূল্য, যেভাবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে অল্প দামে যে কোনো জিনিস কেনার জন্যই মানুষ ভিড় করতে পারে। যদি ঘোষণা দেয়া যায় যে, মুরগি ২০ টাকা, গরুর গোশত ৫০ টাকা, চাল ১০ টাকা বা আলু-পেঁয়াজ ২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হবে, তাহলেও এ ধরনের ক্রেতার ভিড় হবে। কারণ বিদ্যমান বাজারদরে এসব খাদ্যবস্তু অধিকাংশ মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতার প্রায় বাইরে অথবা চালের মতো জিনিস কিনতে হয় অনেক কষ্ট করে। কাজেই তিন টাকা দরে ডিম বিক্রির ঘোষণা শোনার পর মানুষ যেভাবে লম্বা লাইন দিয়ে খুব সকাল থেকে খামারবাড়ীর সামনে দাঁড়িয়েছে, তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় স্বাভাবিক। কিন্তু যা স্বাভাবিক নয় তা হল, মানুষ লাইন দিয়ে থাকা সত্ত্বেও কাউন্টারের মুখে সৃষ্ট কিছু চাপ বা বিশৃঙ্খলা সামাল দেয়ার মতো অবস্থা আয়োজকদের না থাকা। প্রথমত, তাদের এটা অবশ্যই ধরে রাখা দরকার ছিল যে, এ পরিস্থিতিতে কিছু বিশৃঙ্খলা হতে পারে। অভিজ্ঞতাতেও দেখা গেছে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কিছু বিশৃঙ্খলা অনেক সময় হয়ে থাকে। তার জন্য পুলিশের সাহায্য নেয়ার ব্যবস্থা হতে পারত; ক্রেতাদের মার দেয়ার জন্য নয়, তাদের চাপ সৃষ্টি না করে লাইনে দাঁড়াতে সাহায্য করার জন্য। আয়োজকদের নিজেদের লোকরাও তা করতে পারতেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো ব্যবস্থাই সেখানে ছিল না। তার জায়গায় তারা মাত্র অল্পক্ষণ এক একজনকে ২০-৩০টা করে ডিম বিক্রি করে চাপাচাপির মধ্যে বিক্রি একেবারে বন্ধ করেন। এর ফলে শত শত লোক সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ডিমশূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হন। তাদের হয়রানির এক শেষ হয়।

আসলে কী কারণে এভাবে ডিম বিক্রি বন্ধ হল, যেখানে ‘এক লাখ ডিম’ আনা হয়েছিল বিক্রির জন্য বলে আয়োজকরা দাবি করলেন। এটা এক রহস্যজনক ব্যাপার। এক ধরনের ধাপ্পাবাজিও হতে পারে। কারণ যে চাপ সৃষ্টির কথা বলে বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে, সেটা দুই দিকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক লাইন ভেঙে এসে করেনি। সামনের দিকে কিছু লোক করেছিল। এ ধরনের চাপ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে ‘এক লাখ ডিম’ বিক্রি একেবারে বন্ধ না করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে বিক্রি আবার শুরু করা অবশ্যই যেত। কিন্তু সেটা না করে সাধারণ ক্রেতারা কাউন্টারের সামনে চাপ সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে, এ কথা বলে বিক্রি একেবারে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। সস্তায় ডিম বিক্রির ঘোষণা দিয়ে সাধারণ অল্পবিত্ত মানুষকে এভাবে হয়রানির মধ্যে ফেলার অধিকার ডিমওয়ালাদের নেই।

ডিম বিক্রির এ বিষয়টি নিয়ে এতক্ষণ এত কথা বলার দরকার হল এ কারণে যে, বিষয়টিকে সাধারণভাবে তুচ্ছ মনে হলেও এ ঘটনা তুচ্ছ বা অবজ্ঞা করার মতো নয়। এর মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশের সমাজের কী অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার একটা স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। দেশে যেভাবে বাজারে আগুন লেগেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের, বিশেষত খাদ্যের মূল্য যেভাবে ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে তার একটা পরিচয় এই ঘটনার মধ্যে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে এখন ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটতরাজের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষ ভালো অথবা খুব ভালো আছে। বাকি ৮০ শতাংশের অবস্থা খারাপ অথবা খুব খারাপ। তিন টাকা দরে ডিম কেনার জন্য যারা ১৩ অক্টোবর শুক্রবার খামারবাড়ীতে লাইন দিয়েছিলেন, তারা এই ৮০ শতাংশভুক্ত। এদের মধ্যে আছেন কলকারখানার শ্রমিক এবং সরকারি-বেসরকারি অফিস ও সংস্থার নির্দিষ্ট মাসিক আয়ের লোক। এছাড়া আছেন নানা ধরনের দিনমজুর। মূল্যবৃদ্ধির কারণে এদেরকে অনেক জিনিস খাওয়া বাদ দিতে হচ্ছে এবং অন্য জিনিস খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এভাবে বৃদ্ধির কারণে পুষ্টিকর খাদ্য তো দূরের কথা, নিজেদেরকে কোনোরকমে কর্মক্ষম রাখা অথবা প্রাণ বাঁচানোর মতো খাদ্যের সংস্থানও এখন এক কঠিন ব্যাপার।

অন্যদিকে ২০ শতাংশ লোকের খাদ্য নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। ঢাকায় এখন এক একটি এলাকায় শত শত মিষ্টির দোকান, কনফেকশনারি, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং সারা শহরে এদের সংখ্যা হাজার হাজার। এদের জিনিস যতই মহার্ঘ হোক, ক্রেতার অভাব নেই। মাছ, গোশত, সবজির দোকানেও ক্রেতার অভাব নেই। এসবের এমন ক্রেতাও আছে যাদের চালের দাম দু’শ টাকা কেজি, মুরগির কেজি পাঁচ-সাতশ’ টাকা, গরুর গোশত হাজার টাকা বা তারও বেশি কেজি এবং অন্যসব জিনিসের দাম এগুলোর মতো হলেও কোনো অসুবিধা নেই। তাদের কথা হল, ‘কুছ পরোয়া নেই’। যারা নানাভাবে দুর্নীতি করছে তারা শুধু খাদ্যমূল্য নিয়েই যে কোনো চিন্তা করছে না তাই নয়, তারা সরাসরি সরকারি লোক হিসেবে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অথবা সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত থেকে অথবা সরকারের বাইরে থেকেও শাসকশ্রেণীর লোক হিসেবে টাকার পাহাড় বানিয়ে অতিরিক্ত ভালো আছে। ২০ শতাংশ লোক যদি ৮০ শতাংশ লোকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পকেটস্থ না করত, তাহলে খামারবাড়ীর সামনে তিন টাকায় ডিম কেনার জন্য লোকে এভাবে লাইন দিত না। এরা হল ৮০ শতাংশের লোক এবং এক লাখ ডিম তিন টাকা দরে বিক্রির কথা বলে যারা ডিম বিক্রি বন্ধ করল তারা হল ২০ শতাংশের লোক। কাজেই একধরনের শ্রেণী-দ্বন্দ্বের চিত্রই যে এ ঘটনার মধ্যে পাওয়া যায় এতে আর সন্দেহ কী?

১৪.১০.২০১৭

 

https://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/10/15/163431