১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:৫৯

নীল তিমির কালো দংশনতৃতীয় নয়ন

মীযানুল করীম

বাংলাদেশ এখন হামলা, হরণ ও হননসহ হরেক কিসিমের হানাহানিতে নৈরাজ্যের পাদপীঠ! এর মধ্যে বিশেষ করে, আত্মহননের মারাত্মক প্রবণতা ও সংক্রমণ সারা দেশে মহামারির আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সর্বশেষ, আত্মহননের বিশেষ কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে ব্লু হোয়েল নামে ‘সুইসাইড গেম’। বিজ্ঞানের আশীর্বাদের মতো অভিশাপও বড়। তার একটি প্রমাণ অনলাইন গেম ‘ব্লু হোয়েল’। পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে, এই মারণক্রীড়ায় একবার ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। পাশের ভারত আর দূরের রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এ যাবৎ কয়েক শ’ কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণী এই তিমির গ্রাসে জীবন দিয়েছে। যে রাশিয়ার এক যুবকের উদ্ভাবন এই গেম, সে দেশের জন্যও এটি বুমেরাং বা আত্মঘাতী হিসেবে প্রমাণিত।

বাংলাদেশের ধারেকাছেও তিমি বা whale নেই; রঙ blue, white, black যা-ই হোক। তবুও blue whale এখন এ দেশের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয়। রোহিঙ্গা আর প্রধান বিচারপতি ইস্যুর পাশে ‘নীল তিমি’ও গত ক’দিনে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়ে উঠেছে। নীল তিমির মোহে মত্ত হয়ে জীবন বিসর্জনের পেছনে দায়ী কি অভিভাবকেরা, না শিক্ষাব্যবস্থা, নাকি সার্বিক জীবনদৃষ্টি? এ বিতর্কও কম নয়। তর্কবিতর্ক যতই হোক, যথাশীঘ্র স্থায়ী সমাধান চাই এই নতুন সঙ্কটের। এ দিকে প্রতিদিন পত্রিকায় ব্লু হোয়েলের খবর আসছে। এই তিমি সাগরে নয়, আমাদের সমাজেই তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের তিমির অপমৃত্যু মিডিয়ার খবর হয়; এই নীল তিমি নিজেই তরুণ তরুণীদের ঠেলে দিচ্ছে অপমৃত্যুর দিকে।

Blue whale বা নীল তিমিকে বর্তমান পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তিমিকে অনেকে তিমি ‘মাছ’ও বলে থাকেন। কারণ এটি মাছের মতোই পানিতে থাকে, সাঁতার কাটে, ডুব দেয়। দেখতেও বিশাল মৎস্যের আকৃতির। অথচ তিমি মাছ নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী। পশুদের মতো সন্তান প্রসব করে; ডিম দেয় না মাছের মতো। তিমির মধ্যে নানা ধরন আছে। যেমনÑ স্পার্ম হোয়েল, পাইলট হোয়েল, কিলার হোয়েল প্রভৃতি। ক্ষুদ্রাকৃতির হলেও সাদা-কালো কিলার হোয়েল মাংসাশী। ইংরেজিতে Have a whale of time কথাটার whale মানে, ‘সময়কে খুব মজা করে উপভোগ করা।’ যা হোক, এখন ডিজিটাল যুগে দেখা যাচ্ছে, অনলাইন বিনোদনের blue whale হয়ে উঠেছে Killer whale আর এই নীল তিমির কৃষ্ণদংশনে আত্মাহুতি দিচ্ছে একের পর এক সম্ভাবনাময় প্রাণ।
দিন দিন ‘প্রযুক্তি বাড়ছে আর যুক্তি কমছে’। কথাটা যে সত্য, তা চার পাশে সবাই দেখতে পাচ্ছেন। সিগারেট যেমন ধূমপায়ীকে একসময় ‘খেয়ে ফেলে’, তেমনি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকেই খোদ প্রযুক্তির গ্রাসে পড়ছে। যেমন, ব্লু হোয়েল তার বিশাল মুখগহবরে টেনে নিয়ে উদরপূর্তি করছে অপরিণামদর্শী শিশু, কিশোর, যুবাদের দিয়ে। এর কারণ ও উৎস, প্রতিকার ও সমাধান, প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা কম হচ্ছে না।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এর একটি কারণ তুলে ধরে বলেছেন, ‘শিশু-কিশোর ও তরুণদের খেলাধুলার জায়গা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। ফলে ওরা ঘরে আটকা পড়ে প্রযুক্তিনির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছে। এই সুযোগে অশুভ চক্র ব্লু হোয়েল নামে ভয়াল ফাঁদ তৈরি করেছে। এই মারণখেলা থেকে বাঁচাতে এখন থেকেই সন্তান ও ভাইবোনদের ওপর নজর রাখতে হবে।’
এ দেশের ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের নেশায় কিশোর-তরুনেরা মেতে ওঠার ‘অভিযোগ থাকলেও প্রমাণ নেই’ মনে করে কেউ কেউ আত্মপ্রসাদ বোধ করতে পারেন। কিন্তু এই আত্মবিধ্বংসী মৃত্যুখেলায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে একে একে। শুক্রবার পত্রিকার খবরÑ বাংলাদেশে অনেকেই ‘ব্লু হোয়েল’ নেশায় আসক্ত হলেও সংখ্যাটা কারো জানা নেই। তবে পুলিশ ও স্বজনসহ সমাজের সচেতনতায় বিভিন্ন স্থানে এমন কয়েকজন শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরে এসেছে। কেবল একটি পাবলিক ভার্সিটিতেই ‘ব্লু হোয়েল’ আসক্ত অন্তত পাঁচজনের সন্ধান মিলেছে।
পরিণতি টের পেয়ে মাঝপথে ফিরে আসার ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। মিরপুর কাজীপাড়ার এক কিশোর নবম শ্রেণীতে পড়ে। দেড় মাস আগে ব্লু হোয়েল গেমের খপ্পরে পড়ে যায় সে। তবে শেষাবধি কী হবে, বুঝতে পেরে খেলার একাদশ ধাপে সে বিরত হয় এবং মোবাইল ফোনসেট ভেঙে ফেলে গেমটি মুছতে না পেরে। তবুও মানসিক যাতনা এমন চরমে পৌঁছে যে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে সে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। এক বিদেশী বন্ধু তাকে ব্লু হোয়েলের খোঁজ দিয়েছিল। কয়েক ধাপ খেলেই সে বুঝতে পারে, শেষ পরিণাম হলো মৃত্যু। এতে প্রলুব্ধ করার জন্য কয়েকটি সোজা ও মজাদার শর্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১১ নম্বর ধাপে নির্দেশমতো নিজের হাত কেটে ছবি পাঠালেও জবাব আসে, ‘কিছুই হয়নি।’ সেই সাথে দেয়া হলো বকুনি। তারপর কঠিন কঠিন শর্ত দেয়া হলে কিশোরটি এই খেলা ছেড়ে দেয়। নির্দেশ মতো হাত কাটা না হলে তার বাবা-মায়ের ক্ষতি করা হবে বলে তাকে হুমকিও দেয়া হয়েছিল।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এই স্কুলছাত্রের খবর পেয়ে ডিএমপি নড়েচড়ে বসেছে। স্বয়ং ডিএমপি কমিশনার সাইবার ক্রাইম শাখাকে এ ব্যাপারে খতিয়ে দেখতে বলেছেন। পুলিশের ধারণা, মাদকাসক্তি থেকে ছেলেটি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। জানা গেছে, সে মোবাইল ও কম্পিউটার চালাতে পারদর্শী। সারাক্ষণ পড়ে থাকে কম্পিউটার ফেসবুক ইউটিউব নিয়ে। এবার ঈদের কয়েক দিন পর মা-বাবা তার আচরণে রুক্ষতা লক্ষ করেন। এখন তাকে দেয়া হবে মনোচিকিৎসা।

গ্রামাঞ্চলেও ব্লু হোয়েলের কালো থাবার বিস্তার ঘটছে। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার এক গ্রামের এক স্কুলশিক্ষার্থী প্রায় সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। কয়েক দিন যাবৎ ওর আচার-আচরণ কেমন যেন বদলে যেতে দেখে মা তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যান। তখন সে স্বীকার করে, ব্লু হোয়েল খেলা শুরু করেছে। তার প্রাথমিক চিকিৎসা হলেও মায়ের দুশ্চিন্তা কাটছে না।
ছাত্রটি ইন্টারনেটে সন্ধান পেয়ে নির্দেশনামাফিক মধ্যরাতে ব্লু হোয়েল ডাউনলোড করেছিল। এরপর তাকে ফোন নম্বর ও ইমেল আইডিসমেত বিস্তারিত ঠিকানা দিতে বলা হয়। সে এসব তথ্য দিলে তাকে গেমসের মেম্বার করে নেয়া হয় এবং খেলা শুরু করে এই কিশোর। তখন ২৪ ঘণ্টা নীরব থেকে প্রতি ঘণ্টায় সে কী করেছে, তা জানিয়ে মেসেজ দেয়া হয়েছে। তবে দেরি হওয়ার আগেই তার মা হস্তক্ষেপ করায় সে এখন আর এই খেলায় নেই। আর কোনো দিন এটা খেলব নাÑ এই অঙ্গীকারের পাশাপাশি তার অনুরোধ, কেউ যেন ব্লু হোয়েলে মেতে না ওঠে।

ব্লু হোয়েল অনলাইন গেমের ৫০টি ধাপ রয়েছে। এগুলো সম্পন্ন করার নির্ধারিত সময় হলো ৫০ দিন। প্রতিটি ধাপের কাজ শেষ করে গেমারকে ছবি পাঠাতে হয়। একেবারে শেষপর্যায়ে ‘খেলোয়াড়’কে বলা হয় আত্মহত্যা করার জন্য। ২০১৩ সালে রাশিয়ায় ‘এফ৫৭’ নামে এই গেমের যাত্রা শুরু। দুই বছর পরে প্রথম অভিযোগ পাওয়া যায়, এতে অংশ নিয়ে আত্মহত্যার শিকার হওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। ফিলিপ বুদেইকিন নামে জনৈক রুশ যুবক এ খেলার উদ্ভাবক। মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল সে। তবে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় তাকে। ‘ব্লু হোয়েল’ গেম প্রচলনের উদ্দেশ্য হিসেবে তার বক্তব্য, ‘সমাজে যাদের কোনো গুরুত্ব নেই, তাদের আত্মহননে প্ররোচনা দেয়ার মাধ্যমে সমাজকে পরিষ্কার করার জন্য এটা করা হয়েছে।’ রাশিয়ায় কমপক্ষে ১৬ জন কিশোরী এই গেম খেলে আত্মহত্যা করেছে। এ জন্য দায়ী করে বুদেইকিনকে আটক করা হয়েছিল।
সম্প্রতি ব্লু হোয়েল খেলা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর প্রদেশের হামিরপুরে ক্লাস সিক্সের এক ছাত্র এর শিকার হয়েছে। সে তার বাবার ফোনে কয়েক দিন ধরে এটি খেলছিল। তার ঝুলন্ত লাশ যখন নামানো হচ্ছিল, তখন মোবাইল ফোনে ‘ব্লু হোয়েল’ চলছিল। পশ্চিমবঙ্গে একজন প্রকৌশল শিক্ষার্থী এ খেলার সাতটি ধাপ পার হয়েছিল। তবে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তখন তার সন্দেহজনক আচরণের বিষয়ে পুলিশকে জানিয়ে দেন। পরে ওই ছাত্র বলেছে, ‘এই গেম খেলা শুরু করলে ফেরত আসতে পারবেন না। বরং নিজেকে মেরে ফেলতে বাধ্য হবেন। আমার সৌভাগ্য, কলেজ কর্তৃপক্ষ, বন্ধুবান্ধব আর পুলিশ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আমাকে বাঁচিয়েছে।’

কোনো কোনো প্রভাবশালী পত্রিকা লিখেছে, বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল’ অনলাইন গেমের প্রতি আসক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটা পড়ে মনে হতে পারে, আমাদের দেশটা দুনিয়ার বাইরে : হয়তো মঙ্গলগ্রহে অবস্থিত। তাই ইন্টারনেট আসক্তির অমঙ্গল আমাদের কলুষিত করতে অক্ষম! বৃহস্পতিবার পত্রিকার খবর : ‘অনলাইনে ভয়ঙ্কর সুইসাইড গেম। ব্লু হোয়েলে আসক্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যার পথ থেকে বাঁচাল পুলিশ।’ একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, গত মঙ্গলবার ইতিহাস বিভাগের এই শিক্ষার্থীকে পুলিশ হেফাজতে এনে কাউন্সেলিং দেয়া হয়েছে। সে ৫ অক্টোবর ব্লু হোয়েল গেম খেলা শুরু করে। এতে কয়েক ধাপ পার হয়ে সে অপেক্ষা করছিল আত্মহত্যার জন্য। এর আগে তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি লিঙ্ক এসেছিল। এটি ক্লিক করার পর গেমটি ডাউনলোড হয়ে যায় মোবাইলে। এরপর ওই শিক্ষার্থী এটি খেলায় রাজি হলে পয়লা ধাপে গভীর রাতে পুরো ক্যাম্পাস হেঁটে আসার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়। এতে উত্তীর্ণ হলে পরের ধাপে হলের ছাদে রেলিংয়ে হাঁটার চ্যালেঞ্জ আসে। পরবর্তী ধাপে ব্লেডে হাত কেটে সে তিমির ছবি আঁকে। চতুর্থ ধাপ ছিল, দিনভর নীরবে বসে থাকা। এ পর্যায়ে অকস্মাৎ টের পেয়ে হলের এক ছাত্র ফেসবুকে পুলিশের নজরে আনে ঘটনাটি। তখন পুলিশ তাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে ২৪ ঘণ্টারও বেশি কাউন্সেলিং করে। এতে আপাতসুফল পেলেও ছাত্রটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে শর্তসাপেক্ষে। প্রথম শর্ত, সে ছয় মাস ধরে পুলিশের পর্যবেক্ষণে থাকবে। দ্বিতীয়, কোনো ধরনের স্মার্টফোন সে ব্যবহার করতে পারবে না।

ব্লু হোয়েল খেলায় মেতে ওঠা, ঢাকা হলি ক্রসের ছাত্রী স্বর্ণার আলোচিত আত্মহত্যার কয়েক দিন পরের ঘটনা। গত সোমবার বেলা ১টায় কুমিল্লার এক কলেজছাত্র ফেসবুকে জানায়, ‘এখন ব্লু হোয়েলের ৫০তম ধাপ খেলতে যাচ্ছি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়’। তার এক বন্ধু এই স্ট্যাটাস দেখে তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। অথচ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম ‘দর্শনহীন শিক্ষার ফল ব্লু হোয়েল সংস্কৃতি।’ একজন কথাসাহিত্যিক এতে বলেছেন, প্রথম ও প্রধান ভুল শিক্ষাব্যবস্থায়। তিনি পণ্য ও প্রযুক্তিপূর্ণ আধুনিক জীবনযাত্রায় মূল্যবোধের দারিদ্র্য তুলে ধরে বলছেন, ‘এই যে হাজারটা অপ্রয়োজনীয় পণ্য জীবনে ঢুকে গেল এবং জীবনকে আরো নিষ্ফল প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিলো, এ-ও একরকম ব্লু হোয়েলের চোরাবালি।’ লেখক আরো বলেছেন, ‘যে শিক্ষা নিজের ভোগমত্ততা ছাড়া অন্যের কাজে আসে না, শিক্ষার্থীকে নির্লোভ রাখে না, পীড়িত দুর্বল অক্ষমকে সাহায্য করতে শেখায় না, সেই শিক্ষার শেষ পরিণতি যে কী, তা চার পাশে তাকালেই দেখতে পাই।... প্রযুক্তির প্রবেশদ্বার দিয়ে, বিশ্বায়নের সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের (ইন্টারনেটে আসক্ত শিশু-কিশোর) সংযোগ ঘটেছে, কিন্তু বন্ধ হয়েছে মানুষ এবং চার পাশের প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের দুয়ার। সে শিশু শুধু পায়, তবে জীবন হয়ে যায় বদ্ধ গুহা। পরিণতি, ব্লু হোয়েল আসক্তি।’

ইতোমধ্যেই মোবাইল ও ফেসবুকের মাধ্যমে নানা অপরাধ আর সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এটা অভিভাবক, প্রশাসন, চিন্তাশীল মহলÑ সবার নিদারুণ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এখন ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের সংক্রমণ ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া’ হয়ে দেখা দিয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, ফেসবুক, গুগল, ইনস্টাগ্রাম, মাইক্রোসফট, ইয়াহুসহ ইন্টারনেট থেকে এই মৃত্যুখেলার লিংক সরিয়ে ফেলতে হবে। জানা যায়, ব্লু হোয়েলের অ্যাডমিন যারা চালায়, এরা খুব চতুর বলে প্রথম কয়েক ধাপেই শিকার চিহ্নিত করে ফেলে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী এই ‘তিমি’কে চেনে। ঢাকার কয়েকটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষার্থী এখন ব্লু হোয়েলের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে প্ররোচনার পাশাপাশি সাহসের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এ ক্ষেত্রে। ব্লু হোয়েল খেলার পরিণাম জানা সত্ত্বেও নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ এবং সাহসিকতা প্রদর্শন করতে গিয়ে অনেক তরুণ এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। সচেতন নাগরিকেরা মনে করেন, ‘ব্লু হোয়েল’সহ এ ধরনের যেসব নতুন নতুন সমস্যা নবীনদের মাঝে দেখা দিচ্ছে, এগুলোর মূল কারণÑ তাদের নৈতিক মূল্যবোধ, তথা উচ্চতর মানবিক ও মননশীল চিন্তাভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতে না পারা। এটা প্রথমত অভিভাবকদের বিরাট ব্যর্থতা এবং সেই সাথে শিক্ষাব্যবস্থাসহ গোটা সমাজও এ অবস্থার জন্য কম দায়ী নয়। পৃথিবীতে বিশ্বায়নের নামে, মুক্ত অর্থনীতির সুবাদে এবং প্রগতিবাদের স্লোগানে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও নীতিনৈতিকতার ঘোর দুর্দিন চলছে। সামষ্টিক কল্যাণচিন্তা এবং পারস্পরিক সহমর্মিতার বদলে স্বার্থদুষ্ট মনোভাব আর একচেটিয়া ভোগবাদের এখন সর্বত্র প্রবল প্রতাপ। এর কুপ্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোর তরুণদের ওপর। তারা সামাজিক অবক্ষয় আর পারিবারিক বিপর্যয়ের মাঝে বড় হচ্ছে। ফলে নেতিবাচক ভাবনা আর মূল্যবোধহীনতা গ্রাস করে নিচ্ছে নবীন প্রজন্মকে। তারা সুস্থ বিনোদন, মানুষ হওয়ার শিক্ষা, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ, প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত। এই প্রেক্ষাপটে প্রথমে মা-বাবাসহ পরিবারকে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হতে হবে।

অভিভাবক, সমাজ ও প্রশাসনের উদাসীনতা কিংবা অযৌক্তিক আতঙ্কÑ কোনোটাই কাম্য নয়। সতর্কতা ও সক্রিয়তা, তথা সুস্থ পরিবেশ, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, সৃজনশীলতার প্রসার, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই ‘নীল তিমি’কে রোধ করতে পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259983