১৫ অক্টোবর ২০১৭, রবিবার, ১১:৫৮

হঠাৎ সুর বদলে গেল কেনচলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

মিয়ানমারের লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গার বাংলাদেশে চলে আসা নিয়ে শুরুতে সরকার এমন একটা ভাব নিল যে, আমরা জার্মানি হয়ে গেছি। ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আমাদের জন্য কিছুই নয়। আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশিয়ে তাদের কর্মীবাহিনী হিসেবে গড়ে তুলব। জার্মানি ৯ লাখ সিরীয় উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে। কারণ, তাদের জনবলের তীব্র সঙ্কট রয়েছে। তাদের দেশে শ্রমপ্রধান কাজ করার জন্য বহু লোকের দরকার। এই উদ্বাস্তুরা একসময় কর্মীবাহিনী হবে ঠিকই, কিন্তু কখনো জার্মান নাগরিকত্ব পাবে না। এতে তারা ধীরে ধীরে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করবে, যেখানে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। অর্থাৎ জার্মানির শ্রমিক সঙ্কট সাময়িকভাবে দূর হলেও এই উদ্বাস্তুদের দিয়ে তাদের সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হবে না। কিন্তু আপাতত শ্রমিক চাই জার্মানির।

সন্দেহ নেই, আমরা অসহায় নির্যাতিত লাঞ্ছিত নিষ্পেষিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের আশ্রয় দিয়ে মহান মানবিক দায়িত্ব পালন করেছি। এ জন্য আওয়ামী লীগাররা তৈল মর্দনের জন্য শেখ হাসিনাকে বিশ্ব মানবতার জননী, বিশ্বনেত্রী প্রভৃতি উপাধি ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছে। জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য গত ২৪ আগস্ট রাত থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের বৌদ্ধ মগ সহযোগীরা রাখাইনের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে হামলা চালায়। তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে শস্যক্ষেতে আগুন ধরিয়ে দেয়। রোহিঙ্গা যুব পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। নারী ও মেয়েশিশুদের ধর্ষণ করে হত্যা করে। এখানে আসা রোহিঙ্গাদের মুখে তার লোমহর্ষক বিবরণ আমরা শুনেছি। কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের ওপর এ ধরনের অত্যাচার করতে পারে, তা ছিল কল্পনাতীত। সে নির্যাতনের ধারা, সে অগ্নিসংযোগ এখনো চলছে। এখনো প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে ছুটে আসছে। আগে থেকেই বাংলাদেশে রয়েছে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। এখন নতুন করে এসেছে আরো ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। তারা আসছেই।

এদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসঙ্ঘে এক আবেগতাড়িত ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে তিনি আশ্রয় দেবেন। বলেছেন, আমরা যদি ১৬ কোটি লোককে খাওয়াতে পারি, তবে আরো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকেও খাওয়াতে পারব। প্রয়োজনে তাদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খাবো। দিনে এক বেলা খাবো। এমন চমৎকার ভাষণ আজকাল সহজে শোনা যায় না। পৃথিবীর খুব কম দেশেরই এ কথা বলার সাহস আছে। তিনি ভেবেছিলেন, তার এই ভাষণে গোটা বিশ্ব করতালি দিয়ে ধন্য ধন্য রব তুলবে। কিন্তু তা হয়নি। এতে কোনো কোনো আওয়ামী চামচা এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে, বলে বসেছিলেন, এ জন্য তিনি এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা দেখেছি, তিনি যখন এ ভাষণ দেন, তখন শ্রোতা ছিল খুব কম। দুনিয়া উদ্বিগ্ন ছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তার সরকারের জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে। একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার বিরুদ্ধে। মনে হয়, খুব অসহায় অবস্থা থেকে শেখ হাসিনা এমন ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, পৃথিবীতে এখন বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু বলে কোনো রাষ্ট্র নেই। সবাই প্রভু হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সরকার ভেবেছিল, যেকোনো সঙ্কটে বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত। কারণ, ভারতকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই সরকার দিয়ে দিয়েছে ট্রানজিট, করিডোর, রেলপথ, নৌপথ, সড়কপথ, বন্দর সব কিছু। ভারতের আর বাংলাদেশের কাছে কিছুই পাওয়ার নেই। ফলে ভারত খুব স্পষ্টভাবেই বাংলাদেশকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাশে নয়, থাকবে মিয়ানমারের সাথে। এমনকি ভারত রোহিঙ্গা সঙ্কটে মধ্যস্থতাও করবে না।

চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব ভালো বলে সরকারের দাবি। চীন বাংলাদেশকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। নানা প্রকল্পে কাজ চলছে; কিন্তু চীনও দাঁড়িয়েছে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে। ভারতকে সরকার যে সুবিধা দিয়েছে, তা কৌশলগতভাবে চীনের স্বার্থবিরোধী। এটা কূটনীতিহীনতার কারণে সরকার কোনো সময় বিবেচনায় নেয়নি। সরকারের ‘ভালো সম্পর্ক’ রাশিয়ার সাথেও। কিন্তু রাশিয়াও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। জাতিসঙ্ঘে চলতি পথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে একঝলক দেখা হয়েছিল শেখ হাসিনার। কথা বলার সুযোগই দেননি ট্রাম্প। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ট্রাম্পের সাথে এ নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। বন্ধুরা মিয়ানমার সঙ্কটে ভিক্ষা হিসেবে কিছু ত্রাণ পাঠিয়েছে। কোনো কূটনৈতিক সমর্থন দেয়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর অভিমান করা ছাড়া আর কী করার ছিল। আর সে অভিমান থেকেই তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোককে যদি খাওয়াতে পারি, তা হলে আরো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকেও আমরা খাওয়াতে পারব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক-সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যত দিন পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের তরফ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তত দিন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য আমাদের সীমান্ত শিথিলই থাকবে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা গ্রাম, ঘরবাড়ি এখনো জ্বালাচ্ছে। তা হলে ধরে নেয়া যায়, যত দিন পর্যন্ত সব রোহিঙ্গা মুসলমানের বাংলাদেশে আসা শেষ না হবে, তত দিন পর্যন্ত সীমান্ত শিথিলই থাকবে।

তুরস্ক ছাড়া দুনিয়ার কোনো মুসলিম দেশ, ওআইসি বা অন্য কেউ এসে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। এর কারণ, মুসলিম জগৎ থেকে এ সরকার বহু আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়া তো বন্ধ করেছেই, সেই সাথে ভিসা, ট্রানজিট ভিসাও বন্ধ করে দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা সরকার জোরজবরদস্তির মুখে পরিবর্তন করায় আইডিবি, সৌদি আরব সবাই নাখোশ হয়েছে। তারা তা গোপন রাখেনি। অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। ভারতের দাসত্ব করতে গিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতাদের যখন একের পর এক ফাঁসি দেয়া হয়, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান তাদের মৃত্যুদণ্ড রহিত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাতে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন। কোথায় তুরস্ক আর কোথায় বাংলাদেশ। কিন্তু এখন তুরস্ক বলেছে, তারা এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। এ রকম প্রতিশ্রুতি আর কেউ দেয়নি। তবে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, মিয়ানমারকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে হবে। বাকি সবাই চুপ।

কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতি অন্ততপক্ষে ৫০ বছর সামনে রেখে প্রণয়ন করতে হয়। কেবল বিরোধী দল দমনের মধ্য দিয়ে তার নিষ্পত্তি করা যায় না। রাষ্ট্রের স্বার্থে বিরোধী দলকে সাথে নিয়েই সে পরিকল্পনা করা জরুরি; কিন্তু বর্তমান সরকারের এমন কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই। যেখানে এক ব্যক্তির শাসনই মুখ্য, সেখানে সুদূরপ্রসারী নীতি আশা করা যায় না। সে কারণেই সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকার কূটনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তাদের আশঙ্কা, সরকারের এই ব্যর্থতার কারণে দেশকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে। তারা বলেন, এ সমস্যার আশু সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করবে। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের আরো জটিল ঘটনার কারণে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্য দিকে সরে যেতে পারে। তারা বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীর চাপ সহ্য করা দুরূহ হয়ে পড়বে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যু ভয়াবহ নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এ বিরাট জনগোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ রাখা প্রায় অসম্ভব। ফলে জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রচেষ্টায় স্থানীয়দের সাথে প্রতিযোগিতা, এমনকি দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে পড়তে পারে। সব চেয়ে শঙ্কার বিষয় হলোÑ চরমভাবে নিগৃহীত ও ক্ষুব্ধ এ জনগোষ্ঠীকে স্বার্থান্বেষী মহল উগ্রবাদে প্ররোচিত করতে পারে। এ আশঙ্কা অমূলক নয়।

আর কূটনীতিহীনতার কারণে সরকারের কী বিধিলিপি! যে পাকিস্তানের নাম শুনলে সরকারের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। অন্যদের গালাগালি তো করেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেও প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের উদাহরণ টানায় তার সমালোচনা করেছেন। আর সরকারের চামচারা সিনহাকে রাজাকার হিসেবে অভিহিত করে তাকে পাকিস্তান চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই যে, প্রধান বিচাপতি সিনহাকে ছুটিতে গিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আর বাংলাদেশ সেই রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িঘরে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে পাকিস্তানকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার নবনিযুক্ত পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসীর সঙ্গে ইসলামাবাদে দেখা করে এ অনুরোধ জানান। আব্বাসীকে এই অনুরোধের অর্থ হলো, তিনি যেন চীনকে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় সহায়তা করেন। নিজেদের কোনো কূটনৈতিক শক্তি নেই।

আর এর মধ্যেই সব কিছু কেমন যেন বদলে গেল। সড়ক-সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এখন বলছেন, দীর্ঘকাল ধরে রোহিঙ্গাদের বোঝা বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, সেটা অসম্ভব। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন বলছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী যে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের সাথে খাবার ভাগ করে খাবেন, তার কী হলো? এগুলোকেই অপরিণামদর্শিতা বলে। সরকার অপরিণামদর্শী।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259984