১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৯

সাধ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে খাদ্যের খরচ

চাল, শাকসবজিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের সাধ্যের সীমা ছাড়াতে চলেছে। দেখা গেছে, ছোট একটি পরিবারের শুধু খাওয়ার খরচই বেড়েছে মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো।
সে তুলনায় আয় বাড়েনি বললেই চলে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির তথ্য দেখা যায়। শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এ জন্য বন্যার মতো কিছু কারণকে কেউ কেউ অজুহাত হিসেবে দেখালেও মানতে রাজি নয় অনেকেই। রাজধানীর পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের শাকসবজির দামে ব্যাপক ব্যবধান। খুচরা বাজারে বেগুনের দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে পৌঁছে গেছে। ৭০-৮০ টাকা কেজির নিচে কোনো সবজি মিলছে না।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান এ বিষয়ে গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় সাধ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। বিশেষ করে ফিক্সড ইনকাম গ্রুপ, নিম্নমধ্যবিত্ত—যাদের মাসিক আয় ২০-৩০ হাজার
টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ তাদের অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
চালের বাজারে সরকারের এখনো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকারের চালের মজুদ পর্যাপ্ত পরিমাণ না হলে বাজারে নিয়ন্ত্রণ আসবে না। ’ ক্যাবের সভাপতি আরো বলেন, ‘চালের মজুদ না বাড়ানোর বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ইচ্ছাকৃত, না অদক্ষতার কারণে এ অবস্থা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বন্যার কারণে এবার শাক-সবজির উৎপাদন কম হওয়ায় দাম কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু যেভাবে দাম বেড়েছে তা স্বাভাবিক নয়। বাজারে খুচরা বিক্রেতারা বন্যার অজুহাত দেখিয়ে কত বেশি মুনাফা করা যায় তার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সুব্রত বর্মণ স্ত্রী ও এক শিশুসন্তান নিয়ে গাজীপুর জেলার লতিফপুরে বসবাস করেন। ঢাকায় এসে তিনি ঠিকাদারদের মাধ্যমে দিন হাজিরায় বিদ্যুৎ লাইনের কাজ করেন। গতকাল এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে আমার পরিবারে খাওয়ার খরচ ছিল মাসে সাড়ে চার হাজার টাকার মতো। এখন তা আট হাজারে পৌঁছে গেছে। ’
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বেরোতেই পশ্চিম পাশে একটি চায়ের দোকান। দোকানদার শরীয়তপুরের আব্দুল করিম স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন শেরেবাংলানগর পাকা মার্কেট এলাকার সরকারি কোয়ার্টারের একটি টিনশেডে। দ্রব্যমূল্য নিয়ে অভিমত চাইলে তাঁর মন্তব্য, ‘এখন মানুষের সহ্যক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে। আগে চালের দাম এক টাকা বাড়লে আগারগাঁও বস্তির লোকজন রাস্তায় নেমে আসত। রাস্তা বন্ধ করে শুয়ে থাকত। আমি নিজেও ওই দলে থেকে বিডিআর-পুলিশের মাথায় ইট মেরেছি। আর এখন ৫০ টাকা বাড়লেও কোনো হৈচৈ নেই। সরকার রাস্তায় নামার সব সিস্টেম বন্ধ করে দিয়েছে। এ জন্য বাজারে চাল-ডাল, তরিতরকারির দাম বাড়া নিয়ে কোনো চিন্তা করি না। যা ইনকাম তা দিয়ে যা জোটে তা খেয়ে বেঁচে আছি। ’
আব্দুল করিমের চায়ের দোকানে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরির সন্ধানে থাকা এক যুবক। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে। বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়লেও তাঁদের কোনো অসুবিধা নেই। তাঁদের অনেকেই কাঁচা বাজারে যান না। সুপারশপে আরো চড়া দামের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে বাজার করেন। অসুবিধা হচ্ছে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষের এবং দেশে এদের সংখ্যাই বেশি।

টিসিবির হিসেবে মূল্যবৃদ্ধি : টিসিবির গত বৃহস্পতিবারের হিসাবে এক বছর আগের তুলনায় ঢাকায় চালের দাম মানভেদে ২৫.৪৯ থেকে ৩২.৯৮ শতাংশ বেড়েছে। আর এক মাস আগের তুলনায় বেড়েছে ৩.৩৩ থেকে ৭.৮৪ শতাংশ। ডালের মধ্যে মুগডাল এক সপ্তাহ আগের তুলনায় মানভেদে গড়ে ২.০৪ শতাংশ এবং অ্যাংকর ডাল ১০.৫৩ শতাংশ বেড়েছে। মসুরের ডালের দাম সামান্য কমেছে আর ছোলার ডালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। সাধারণ পিঁয়াজের দাম বেড়েছে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ১১.১১ শতাংশ। আর আমদানি করা পিঁয়াজের দাম বেড়েছে ২১.২৫ শতাংশ। পিঁয়াজের দাম এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে মানভেদে ৩৭.৩৩ থেকে ৭৬.৩৬ শতাংশ। রসুনের দাম কিছুটা কমতির দিকে। আদা মানভেদে বেড়েছে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ২৬.৩২ শতাংশ এবং এক বছর আগের তুলনায় ২০ শতাংশ।
মসলার মধ্যে দারুচিনি এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ১৪.২৯ শতাংশ। এ ছাড়া এলাচি ৬.৬৭, ধনে ৭.৪১ ও তেজপাতা ৩.৪৫ শতাংশ বেড়েছে। গুঁড়ো দুধ এক সপ্তাহ আগের তুলনায় না বাড়লেও এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানভেদে ২.৩০ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত। বয়লার মুরগির দাম বেড়েছে এক সপ্তাহ আগের তুলনায় ৪ শতাংশ। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় গরুর মাংসের দাম না বাড়লেও এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ১৮ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে খাসির মাংসের দাম ৩৮.১০ ও দেশি মুরগির দাম ৬.৯০ শতাংশ বেড়েছে। মাছের মধ্যে রুইয়ের দাম বেড়েছে এক বছর আগের তুলনায় ৮.৩৩ শতাংশ।

অবশ্য টিসিবির প্রতিবেদনে শাক-সবজির বাজারদরের কোনো তথ্য নেই। সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে এ সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ও প্রকৃত অবস্থার তুলনায় কম মূল্য দেখিয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে খুচরা বাজারে এক মাস আগের তুলনায় বেগুনের দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ। তাদের প্রতিবেদনে বেগুনের দাম বর্তমানে ৮০ থেকে ১০০ টাকার বদলে ৬৩ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুসারে ঢেঁড়সের দাম এক মাস আগের তুলনায় বেড়েছে ৩৩.৩৩ শতাংশ, কচুর লতির দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ। এ ছাড়া কাঁচা মরিচের দাম ৪২.৮৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ভিন্ন।

সরেজমিন কারওয়ান বাজার : রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গত বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার সকালে সরেজমিনে জানা যায়, সেখানে যে দামে শাক-সবজি পাইকারিভাবে বিক্রি হচ্ছে তার সঙ্গে খুচরা বাজারের দামের ব্যবধান অনেক। কারওয়ান বাজারে শুক্রবার সকালে বেগুনের দাম ছিল পাল্লাপ্রতি (পাঁচ কেজি) ২২০ থেকে ২৮০ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ৪৪ থেকে ৫৬ টাকা। এই বেগুন রাজধানীর খুচরা বাজারে গতকাল বিক্রি হচ্ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারে পাঁচ কেজি ওজনের কাছাকাছি মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছিল প্রতিটি ৬০ থেকে ৮০ টাকায়। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৬ টাকায়। এই কুমড়া খুচরা বাজারে ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ফালি বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। পুঁইশাকের দাম কারওয়ান বাজারে আঁটিপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টাকা। খুচরা বাজারে এর দাম ছিল ৩০ টাকা। তবে কারওয়ান বাজারের দুই আঁটি পুঁইশাক খুচরা বাজারে তিন আঁটিতে পরিণত হয়।

সবজি ব্যাপারী দুদু খাঁ বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জ এলাকা থেকে ঝিঙে এনেছিলেন কারওয়ান বাজারে। বললেন, ‘এখানে ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি করে বিক্রি হবে বলে আশা করছি। অথচ খুচরা বাজারে এই ঝিঙে বিক্রি হয়েছে ১০০ টাকা কেজি। কারওয়ান বাজারে পেঁপের পাইকারি দাম মানভেদে পাল্লাপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকা। আর খুচরা বাজারে তা বিকোচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি। এ ধরনের ব্যাপক বৈষম্য প্রায় সব ধরনের সবজির।
খুচরা বাজারের চিত্র : রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার, নিউ মার্কেট, বনানী বাজারসহ বিভিন্ন খুচরা বাজারে ঘুরে গতকাল জানা যায়, সবখানেই চড়া দামে বিকোচ্ছে শাক-সবজিসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য। এসব বাজারে করলা, উচ্ছে ও কাঁকরোলের দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। লাউ প্রতিটি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, কচুমুখী ৩০ টাকা কেজি। ধনেপাতা ১০০ গ্রাম ২০ টাকা। প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৮০ থেকে ১০০, শসা ১০০, কাঁচা মরিচ ২০০, শুকনা মরিচ ১৮০ এবং জালি কুমড়া প্রতিটি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মোহাম্মদপুর টাউন হলের নিউ হক ভ্যারাইটি স্টোরের মালিক লিটন বলেন, ‘ঈদুল আজহার আগে মসলার দাম বাড়ার পর এখন পর্যন্ত তা অপরিবর্তিত রয়েছে। মসলার মধ্যে কেজিপ্রতি এলাচি ১৮০০, জিরা ৪০০ থেকে ৪৪০, দারুচিনি ৩২০ থেকে ৩৫০, আলুবোখারা ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ময়দার দাম খোলা ৩৫, প্যাকেটজাত ৪৬ টাকা। আর আটা খোলা ৩৩ এবং প্যাকেটজাত কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা। গুঁড়ো দুধের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা বাড়বে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। ’
এদিকে মাছ ও মাংসের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন করে দাম না বাড়লেও চড়া দাম অব্যাহত রয়েছে। কেজিপ্রতি কাতল বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। এ ছাড়া রুই ৩২০ থেকে ৩৫০, পাঙ্গাশ ১৩০ থেকে ১৪০, বড় বোয়াল ৭০০, পাবদা ৩৮০, গলদা চিংড়ি আকারভেদে ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। একইভাবে গরুর মাংস ৪৮০ থেকে ৫০০, ছাগলের মাংস মানভেদে ৬৫০ থেকে ৭৫০ এবং ডিমের দাম প্রতি ডজন ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছিল ব্যবসায়ীরা। ডিমের দাম শতকরা ২০-৩০ টাকা বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানায়। বয়লার মুরগি এক সপ্তাহে কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/10/14/553491