১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৩

এত ফোনসেট লাপাত্তা!

শুধু ৫ হাজার ফোনসেটই নয়, প্রায় সময়ই চুরি হচ্ছে জব্দ স্বর্ণ, বিদেশি মুদ্রাসহ মূল্যবান সামগ্রী * নির্বিকার কর্তৃপক্ষ * গোয়েন্দা নজরদারিতে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারী * নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট টিমের অসন্তোষ
হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ও কাস্টমস গুদামের চুরি থামছেই না। প্রায় সময়ই হদিস মিলছে না এ গুদামে সংরক্ষিত জব্দ করা স্বর্ণ, বিদেশি মুদ্রা, মোবাইল ফোনসেট ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ বিভিন্ন মূল্যবান সমগ্রী। সম্প্রতি গুদাম থেকে উধাও হয়ে গেছে জব্দ করা পাঁচ হাজারের বেশি দামি মোবাইল ফোনসেট। এতে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অবৈধ পথে আনা এসব জব্দ সামগ্রী রহস্যজনকভাবে উধাও হওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিকভাবে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। ওইসব ঘটনায় বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্টরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনও দেয়া হয়। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী ব্যক্তিদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায়, চিহ্নিত ব্যক্তিরা চাকরিতে বহাল তবিয়তেই থাকেন। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে বলে শঙ্কা তাদের। কারণ এসব চুরির ঘটনায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। আর এই সিন্ডিকেটের ওপর রয়েছে প্রভাবশালীদের আশীর্বাদ। যার কারণেই দায়ীদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। শুধু তাই নয়, অভিযোগ আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব চুরির ঘটনা গোপন রাখারও চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ।

তবে বিমানবন্দরের কাস্টমস গুদাম থেকে একসঙ্গে ৫ হাজারের বেশি দামি মোবাইল ফোনসেট চুরির ঘটনায় বেশ তোলপাড় চলছে। গত জুলাই মাসে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডেলিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে জব্দ পণ্য লোপাটের বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বৈঠকে কাস্টমসের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত ৬ মাসে তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অবৈধভাবে আনা ২০ হাজারের বেশি দামি মোবাইল ফোনসেট জব্দ করা হয়েছে। ওই সেটগুলো বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) জিম্মায় দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে। কিন্তু বিটিআরসির প্রতিনিধিরা গুদামে গিয়ে দেখতে পায়, ৫ হাজারের বেশি মোবাইল সেটের হদিস নেই।

ঘটনাটি ফাঁস হয়ে গেলে বিমানের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে কাস্টমস, কার্গো, সিকিউরিটি ও সিভিল এভিয়েশনের প্রতিনিধি রাখা রয়েছে। বিমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহম্মেদ মোবাইল সেটগুলো চুরি নিয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে বলে যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন।

বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, লোপাট হওয়া ৫ হাজার মোবাইল ফোনসেটসহ গত এক বছরে কি পরিমাণ পণ্য উদ্ধার করা হয়েছে ও কত পণ্য চুরি হয়েছে তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র মন্ত্রণালয়ে প্রদানের জন্য তিনি বিমানের এমডিকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে এসব বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজরদারির আওতায় আনা ও পুরো এলাকাটি সিসি টিভির আওতায় আনার জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বিমানসহ সিভিল এভিয়েশনের অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চোরাচালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২১ জন।

সূত্র জানায়, চোরাকারবারিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, চুরি, নিন্মমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার, অদক্ষ ও বহিরাগত জনবল নিয়ে বিমানবন্দর পরিচালনা করার অভিযোগে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্টের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে। শাহজালালের কয়েকটি বিভাগের নিরাপত্তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

জুলাই মাসে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় শাহজালালের ইমপোর্ট কার্গোর মালামাল ডেলিভারি, পুরনো কার্গো মালামাল রাখার অব্যবস্থাপনা, মালামাল ইনভেন্ট্রি করায় অব্যবস্থাপনা ও বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, বিমানের জিইসি ইকুইপমেন্ট না থাকা এবং রানওয়েতে অপ্রয়োজনীয় মালামাল পড়ে থাকা নিয়েও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। ওই বৈঠকের পরপরই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সিভিল এভিয়েশন থেকে সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগের অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নজরদারির আওতায় আনা হয়। এর মধ্যে অ্যাভসেক সেল হেডকোয়ার্টার্সের একজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা, প্রশাসন বিভাগের নিরাপত্তা কর্মকর্তা নাছিমা শাহীন স্বপ্না, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও একজন ডেপুটি চিফ সিকিউরিটি অফিসার, নিরাপত্তা অপারেটর নূপুর রানী বিশ্বাস, সিকিউরিটি গার্ড সাহাবুদ্দিন খন্দকার, ক্লিনার রোকেয়া, নিরাপত্তা অপারেটর প্রতুল চন্দ্র দাস, নিরাপত্তা সুপারভাইজার সালাউদ্দিন, নিরাপত্তা সুপারভাইজার শহিদুল্লাহসহ ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম রয়েছে। এর মধ্যে বেশ ক’জন কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করেও দেয়া হয়েছে।

সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সংস্থার যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন, তাদের মধ্যে অ্যাভসেক সেলের ওই শীর্ষ কর্মকর্তাকে এর আগে সোনা চোরাচালান, বৈদেশিক মুদ্রা ও নিষিদ্ধ ওষুধ পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা কর্মীদের নিন্মমানের পোষাক তৈরি করে ঠিকাদারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার বেশি ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে মামলা হয়েছিল। বছরের অধিকাংশ সময় বিদেশ ভ্রমণসহ বিদেশে ট্রেনিং দেয়ার নামে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা মাসোয়ারা গ্রহণের অভিযোগ আছে। এছাড়া নাছিমা শাহীন স্বপ্না নামের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ আছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে রোস্টার বাণিজ্যের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগও উঠেছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের ক্যারিয়ার হিসেবে পরিচিত নিরাপত্তা কর্মচারীদের ডিউটি বণ্টনে সহযোগিতা করার অভিযোগ আছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নাছিমা শাহিন বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ষড়যন্ত্র। তাকে বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য কেউ কেউ এসব রটনা রটিয়ে থাকতে পারে।

এছাড়া ‘ঘ’ শিফটের একজন প্রভাবশালী ডেপুটি প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তিনিও শাহজালালে সোনা চোরাচালান, আদম পাচার, নিষিদ্ধ ওষুধ, মোবাইল ফোন পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বেবিচকের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তাকে মোটা অংকের মাসোয়ারা দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন শাহজালালের এই শাখায় কর্মরত আছেন। তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে মিরপুর, আশকোনা, ফার্মগেট এলাকায় ৮টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট ক্রয়ের অভিযোগ আছে।

নূপুর রানী বিশ্বাস নামে একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি দীর্ঘদিন বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় কর্মরত থেকে মুদ্রা পাচার, সোনা পাচার করে আসছেন। তার মূল পদ স্টোরকিপার হলেও তিনি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে নিরাপত্তা অপারেটর হিসেবে চলতি দায়িত্ব নিয়ে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে শাহজালালে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৩০০০ ডলার ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে বিমানবন্দরের চিফ সিকিউরিটি অফিসার (সিএসও) তাকে শাস্তি দেন। এরপর থেকে তিনি চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগসাজশে ওই প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তার ওপর ক্ষিপ্ত হন। জানা গেছে, সাহাবুদ্দিন খন্দকার নামে অপর একজন সিকিউরিটি গার্ডের সহায়তায় এই নূপুর রানী শাহজালালে প্রকাশ্যে সিএসও’র সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এ প্রসঙ্গে নূপুর রানী বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সাজানো। প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার ওপর ক্ষিপ্ত হওয়ার অভিযোগও সঠিক নয় বলে তিনি জানান।

অপর দিকে মূল পদবি ক্লিনার হলেও শাহজালালে প্রভাবশালী লাউঞ্জ রুম অ্যাটেনডেন্স (এলআরএ) হিসেবে ডিউটি করে দীর্ঘদিন ধরে চোরাচালান চক্রের সঙ্গে কাজ করছে রোকেয়া নামে একজন কর্মচারী। তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে বিদেশি মদ, বিয়ার, সিহারেট ও সোনার বার পাচারের অভিযোগ আছে। সম্প্রতি তিনিও সিএসও’র হাতেনাতে ধরা পড়েন। এ ঘটনায় তাকে এলআরএ থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়। প্রতুল চন্দ্র দাস নামে একজন নিরাপত্তা অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি দীর্ঘদিন ধরে কার্গো ভিলেজে চোরাচালান চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন ধরনের মালামাল পাচার করছেন। তার বিরুদ্ধে হেরোইন, মূল্যবান চন্দনকাঠ, কষ্টিপাথরের মূর্তি ও বিরল প্রজাতির কচ্চপ পাচারের অভিযোগ আছে। জানা গেছে কার্গো ভিলেজে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের সঙ্গে তার দুই ভাই জড়িত। তারাই মূলত প্রতুল চন্দ্রের মাধ্যমে কার্গো ভিলেজ দিয়ে বিদেশে এসব মূল্যবান চালান পাচার করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টি টের পেয়ে তাকে এখন নজরদারিতে রেখেছে। শুধু প্রতুল চন্দ্রই নয়, তার স্ত্রী লিপিকা রানীর (সিকিউরিটি গার্ড) বিরুদ্ধেও শাহজালালের সোনা, মুদ্রা ও আদম পাচারের অভিযোগ আছে। ২০১৩ সালে হেরোইন ও কচ্চপ পাচারের অভিযোগে প্রতুলের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের হয়েছিল।

এছাড়া মূল পদবি ক্যাশিয়ার হলেও নিরাপত্তা সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করছেন সালাউদ্দিন। তার বিরুদ্ধেও কার্গো ভিলেজে থেকে মূল্যবান চন্দনকাঠ, হেরোইন, মূল্যবান মূর্তি পাচারের অভিযোগ আছে। হেরোইন পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে বিমানবন্দর থানায় মামলাও হয়েছিল। বর্তমানে সে মামলায় জামিনে আছেন তিনি। ওই মামলায় তার সহযোগী হিসেবে যারা জামিনে আছেন, তারাও রয়েছেন গোয়েন্দা নজরদারিতে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন নিরাপত্তা সুপারভাইজার আবদুল জলিল, আবদুল কুদ্দুস মণ্ডল ও নজরুল ইসলাম সিকদার।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/14/163130