১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৫১

ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে আতঙ্ক

বিটিআরসির নামে ভুয়া বার্তা

‘১৩ অক্টোবর শুক্রবার রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এই এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে দেশের সব অ্যানড্রয়েড ফোনে ব্লু হোয়েল গেম ঢুকিয়ে দেয়া হবে। যা প্রবেশের ফলে আপনার ফোনের সব পারসোনাল ইনফরমেশন, ফেসবুক, টুইটার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ সব কিছু ধ্বংস করতে সক্ষম। তাই রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আপনার ফোন বন্ধ রাখুন। আর দেশের সেবায় এটি বেশি বেশি করে ফরোয়ার্ড করুন। জনসচেতনতায় : বিটিআরসি।’

এ ধরনের আহ্বান জানিয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইমো, ভাইবারসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। মেসেজটি পেয়ে কাছের মানুষ, বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিতজনদের ফরোয়ার্ড করছেন আতঙ্কিত অনেকেই। কেউ কেউ আবার ফোন করেও সতর্ক করছেন কাছের মানুষদের। গতকাল দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বেশির ভাগজুড়েই ছিল ব্লু হোয়েল গেম এবং উল্লেখিত তথাকথিত সতর্কীকরণ মেসেজটি। তবে বিটিআরসির বরাত দিয়ে পাঠানো এ বার্তাটির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এমনকি কোথা থেকে বার্তাটির উৎপত্তি সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুরো বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান দেশে ফিরলে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে পারেন বলে জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলছে, ২০১৩ সালে ২২ বছর বয়সী রাশিয়ান তরুণ ফিলিপ বুদেকিন প্রাণঘাতী এ গেমটির আবিষ্কার করেন। ইন্টারনেটের সাময়িক আনন্দ ছাপিয়ে শেষ ধাপে নিজেকে শেষ করে দিয়ে মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ নিতে হয় ব্যবহারকারীকে। এ গেমের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১৮০ জন আত্মহত্যা করেছে। গেমের আসল অ্যাডমিন ফিলিপ বুদেকিনকে আটক করা হলেও বিভিন্ন দেশে এর অ্যাডমিন থাকায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে গেমের প্রভাব এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্লু হোয়েল গেমটি খেললেই মৃত্যুকে আপন মনে হবে, সুইসাইড করতে সহায়ক মনোবৃত্তি তৈরি করে এ ব্লাক গেইমটি! অ্যাপ স্টোর, প্লে স্টোর, ইন্টারনেট বা গুগল কোথাও খুঁজে পাবেন না এ গেম। কারণ এটি ভার্চুয়ালি অবৈধ। একমাত্র একজন গেমার যদি আপনাকে ইনবক্সে বা মেইল আমন্ত্রণ করে, তবেই খুঁজে পেতে পারেন গেমটি। কারো পাঠানো কোনো গোপন লিংকের মাধ্যমে চলে এ হ্যাকারদের তৎপরতা। সাইবেরিয়ার জুলিয়া ওভা ও ভের্নিকা ওভা নামক দুই বোন প্রথম এ গেইমের শিকার। গেমটির ৫০তম লেভেলে গিয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে ওরা সুইসাইড করেছিল। জুলিয়া ওভা মৃত্যুর ঠিক আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নীল তিমির ছবি আপলোড দিয়ে লিখেছিল ‘দ্য ইন্ড’! গেমটি মূলত একটি ডার্ক ওয়েভের গেম। ডার্ক ওয়েভ হলো ইন্টারনেটের অন্ধকার জগত।

গত ৫ অক্টোবর ঢাকার সেন্ট্রাল রোডে অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা নামে এক তরুণী আত্মহত্যা করে। ব্লু হোয়েল গেমের শিকার হয়েই মেধাবী ওই তরুণী নিজেকে শেষ করেছে বলে প্রমাণ পায় তার পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরই বিষয়টি আলোচনায় আসে। গত বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্লু-হোয়েল গেমে আসক্ত এক শিক্ষার্থীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়। ফলে এ গেমের বিপজ্জনক ধাপ সম্পর্কে জানার পর চট্টগ্রামজুড়ে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলে ১৭ বছরের এক কিশোরকে গত বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুর কাজীপাড়ার বাসা থেকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে কৌতূহলবশত ‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলত। গেমটির নির্দেশনা মানতে মানতে একপর্যায়ে নিজের শরীরে ব্লেড দিয়ে ক্ষত করেছে সে। গেমটির শেষের স্টেজে এসে নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ওই কিশোর আত্মহত্যার জন্য ঘুমের ওষুধ খায়। চিকিৎসকেরা তার ডান হাতে ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তাকে প্লাজমা (সাদা রক্ত) দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক হইচই চলছে। তরুণ ও কিশোরদের নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় পড়েছেন অভিভাবকেরা। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দিন ধরে বিটিআরসির নাম ব্যবহার করে সতর্কীকরণ একটি বার্তা ছড়ানো হচ্ছে।

বিটিআরসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি আলোচনায় আসার পর থেকেই বিটিআরসি কর্মকর্তাদের বেশ ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে। আতঙ্কিতদের নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিটিআরসির বরাত দিয়ে ভুয়া বার্তাটি ছড়ানোর পর একেবারেই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফোন করে ব্লু হোয়েল এবং সতর্কীকরণ বার্তাটি সম্পর্কে জানতে চান মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা।
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা গতকাল দুপুরে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে অনেকটাই ক্লান্ত স্বরে বলেন, ‘সারা দেশ থেকে আতঙ্কিত মানুষের ফোনের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। দলমত নির্বিশেষে সবাই ফোন করে বারবার ব্লু হোয়েল এবং মেসেজটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। গত রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। তাই ভাবছি এখন একটু ঘুমাব, তাও পারছি না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ব্লু হোয়েল গেমে বাংলাদেশে কারো আত্মহত্যা হয়েছে কি না তার তদন্ত করতে সোমবার বিটিআরসিকে নির্দেশ দেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, বাংলাদেশে ‘ব্লু হোয়েল গেইম’ লিংক বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং এর ওপর সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিটিআরসির সচিব ও মুখপাত্র সরওয়ার আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, কেউ অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ‘জনসচেতনতায় বিটিআরসি’ এ নাম ব্যবহার করে একটি বার্তা ছড়িয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভুয়া। বিটিআরসি থেকে ব্লু হোয়েল গেম সম্পর্কিত কোনো বার্তা প্রকাশ বা প্রচার করা হয়নি। এ পুরো বার্তাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। বিটিআরসির নাম ব্যবহার করে এ রকম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক বার্তা প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের সাইবার অপরাধ থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক হতে হবে। দেশের সব মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীকে এ বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
তিনি জানান, বিটিআরসি চেয়ারম্যান বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তিনি দেশে ফিরলে ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিআরসি তার অবস্থান জানাতে পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259828