প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত রাতে বিদেশ যাত্রার জন্য বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন
১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৮

আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, বিচার বিভাগ নিয়ে শঙ্কিত

ঢাকা ছাড়ার প্রাক্কালে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা

অস্ট্রেলিয়ার পথে ঢাকা ছাড়লেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। গত রাত ১০টায় কাকরাইলের সরকারি বাসভবন থেকে কড়া পুলিশ প্রহরায় তিনি বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে তাকে বহনকারী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের বিমানটি হজরত শাহজালাল রহ: আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। বিমানবন্দরের উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগের আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে জানান, স্বেচ্ছায় দেশের বাইরে যাচ্ছেন। তিনি আবার দেশে ফিরে আসবেন। বলেন, আমার দৃঢ়বিশ্বাস আমার ব্যাপারে ভুল বোঝানো হয়েছে। বিচার বিভাগ যেন বিব্রত না হয়। ন্যায় বিচারের স্বার্থেই তার এই বিদেশ যাত্রা।

প্রধান বিচারপতি গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দুই মিনিট সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষরিত একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের দেয়া হয়। এরপর তিনি কড়া পুলিশ প্রহরায় বাসভবন ত্যাগ করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। কিন্তু ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধু রুটিন মাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’

রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৭ ফাইটে প্রধান বিচারপতি ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগে রাত সাড়ে ১০টার পর তিনি ভিআইপি গেট দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছান। প্রধান বিচারপতির স্ত্রী সুষমা সিনহাসহ স্বজনেরা বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে তাকে বিদায় জানান।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৭ ফাইটটিতে রয়েছে এয়ারবাস এ৩৩৩ মডেলের উড়োজাহাজ। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী, সিঙ্গাপুরের স্থানীয় সময় শনিবার ভোর ৬টা ৫ মিনিটে সিঙ্গাপুরের চাংগি বিমানবন্দরে অবতরণ করবে ফাইটটি। সেখানে থেকে অন্য একটি ফাইটে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করবেন প্রধান বিচারপতি।
বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় প্রধান বিচারপতির সাথে একই গাড়িতে ছিলেন তার স্ত্রী সুষমা সিনহা। দিনভর প্রধান বিচারপতির দেশ ত্যাগের খবর ছিল আলোচনায়। মূলত বিকেল থেকেই তিনি অস্ট্রেলিয়া রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সকাল থেকে তার সাথে নিকটাত্মীয়রা দেখা করতে আসেন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৭ ফাইটের টিকিট কনফার্ম করেন তিনি।

প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে রাত ১০টায় একটি পুলিশ স্কট এবং পেছনে আরো কয়েকটি গাড়ির প্রহরায় বাসভবন ত্যাগ করেন তিনি। এ সময় কাকরাইলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে বিপুল সাংবাদিক ও বিভিন্ন সংস্থার লোকজন অপেক্ষমাণ ছিলেন। প্রধান বিচারপতি বাসভবনের বাইরে কাকরাইল মসজিদসংলগ্ন হেয়ার রোড দিয়ে বেরিয়ে যান। প্রধান ফটকের কাছে তিনি কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে, তিনি দু-একটি কথা বলেন। তিনি কম্পিউটার কম্পোজ করা লিখিত বক্তব্যটি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে দিয়ে বলেন, আমার বক্তব্য এখানেই আছে।
এ দিকে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদেশ গমনের জন্য বিমানবন্দরে আগে থেকেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। তার বোডিং পাসসহ সব ধরনের দাফতরিক বিষয় আগে থেকে সেরে রাখা হয়। তিনি রাত সাড়ে ১০টার পর সরাসরি বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে টার্মিনালে প্রবেশ করেন।
এ দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, শুক্রবার রাতে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফাইটে বিদেশে যাবেন। প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে তাকে এ তথ্য জানানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
গতকাল প্রধান বিচারপতির প্রটোকল ও ব্যক্তিগত গাড়ি এবং তার একান্ত সচিব মো: আনিসুর রহমানকে দুই দফায় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যেতে পারেন এবং তিনি শুক্রবার রাতেই যাবেন।
ইতোমধ্যে ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে অবস্থানের বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন প্রধান বিচারপতি। গত বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির ছুটিসংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির আবেদনে এর আগে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রধান বিচারপতি যেহেতু আরো বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি নতুন আদেশ দিয়েছেন।

বাসভবনে স্বজনেরা : প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে তার বাসভবনে দেখা করেছেন স্বজনেরা। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে হেয়ার রোডে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যান তারা। স্বজনদের মধ্যে রয়েছেনÑ প্রধান বিচারপতির ভাই এন কে সিনহা, ভাতিজি জামাই রাজমন সিনহা, সুজিত সিনহা ও রামকান্ত সিনহা এবং শ্যালিকা শীলা সিনহা।
সকাল ১০টা ২২ মিনিটে (বাসভবনে) প্রবেশ করেন ভাতিজি জামাই সুজিত সিনহা ও রামকান্ত সিনহা, ১০টা ২৩ মিনিটে প্রবেশ করেন শিলা সিনহা, ১২টা ৪৫ মিনিটে প্রবেশ করেন ভাতিজি জামাই রাজমন সিনহা।
গত ৫ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসে ভিসার জন্য আবেদন করেন প্রধান বিচারপতি। একই সাথে আবেদন করা হয় তার স্ত্রী সুষমা সিনহার ভিসার জন্যও। প্রধান বিচারপতির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, তারা দু’জনে তিন বছরের ভিসা পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বড় মেয়ে বসবাস করেন।

গত ২ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার আগের দিন এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। যদিও প্রচণ্ড চাপে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতিকে জোর করে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। বিষয়টিকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে ইতঃপূর্বে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা।

গত ১০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে ছুটিতে ছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১ আগস্ট প্রকাশের পর থেকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, এমপি এবং নেতারা প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করে বিভিন্ন বক্তব্য রাখেন। জাতীয় সংসদেও তার সমালোচনা করা হয়।
অন্য দিকে প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ায় গত ২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির কার্যভার দিয়েছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধির পাশাপাশি তিনি আবার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিচারপতি মো: আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259846