১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৬

উগ্রবাদী বৌদ্ধভিু উইরাথু হঠাৎ মংডুতে

মুসলমান নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ; রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্মী গুপ্তচর

মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার হোতা উগ্রবাদী বৌদ্ধভিক্ষু অশিন উইরাথু হঠাৎ করে আরাকানের মংডু সফর করছেন। সে দেশে দীর্ঘ দিন ধরে জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছেন এই বৌদ্ধভিক্ষু। মংডুর বিভিন্ন রাখাইন পল্লীর বৌদ্ধদের সাথে বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকে তিনি সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানকে আরো জোরদারে সহায়তা করতে স্থানীয় রাখাইনদের এগিয়ে আসার ও সেখানকার মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার যে আলোচনা করছে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় রাখাইনদের প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ করছেন উইরাথু। মংডুর মুসলমানদের বিভিন্ন সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

উইরাথু গত বুধবার আকিয়াব হয়ে গত বৃহস্পতিবার মংডুতে পৌঁছেন। তার এই সফরকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে বলে মনে করছেন রোহিঙ্গারা। কেননা, রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের উসকানি দিতেই আরাকানে আসেন উইরাথু।
কে এই উইরাথু?
মিয়ানমারে বৌদ্ধদের জঙ্গি নেতা ভিক্ষু অশিন উইরাথ কয়েক দশক ধরে তার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। ২০১২ সালে আরাকানের আকিয়াব ও বুচিডং রাচিডংসহ আরকানের মুসলমানদের বিতাড়িত করতে রাখাইনদের উসকানি দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া সময়ে অসময়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি মুসলিম ধর্মবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। মিয়ানমারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, অশিন উইরাথু তার প্রচারণায় প্রকারান্তরে সেখানকার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন করার কথা বলেছেন। ধর্মীয় গুরু হিসেবে মিয়ানমারসহ সারা বিশ্বে তার কয়েক লাখ অনুসারী রয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাকে মিয়ানমারের বিন লাদেন বলেও আখ্যায়িত করেছে।
জানা যায়, অশিন উইরাথুর জন্ম ১৯৬৮ সালে মিয়ানমারের মান্ডালে শহরে। ১৪ বছর বয়সে তিনি স্কুল ছেড়ে ভিক্ষু বনে যান। ২০০১ সালে তিনি মুসলিমবিরোধী গ্রুপ ‘৯৬৯’ এ যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন। ইসলামবিরোধী প্রচারণার জন্য মিয়ানমার সরকার ২০০৩ সালে তাকে ২৫ বছরের জেল দেয়। ২০১০ সালে তিনি অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে ছাড়া পান। এরপর তার ইসলামবিরোধী প্রচারণা আরো জোরদার হতে থাকে। বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী টাইম’স ২০১৩ সালে ২০ জুন অশিন উইরাথুকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম দেয়া হয় ‘দ্য ফেস অব বুদ্ধিস্ট টেরর।’
উইরাথু ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গুজব ছড়ান। মান্ডালে শহরে মুসলমান সন্ত্রাসীরা একজন বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ করেছেÑ এমন প্রচারণা চালালে সেখানে সহিংসতা শুরু হয়। পরে দেখা যায়, ওই মহিলা আদৌ ধর্ষিতা হননি। এ বিষয়ে উইরাথুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বিবিসিকে জানান, লোকমুখে শুনে তিনি এমনটি করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বৌদ্ধদের উত্তেজিত করেছেন। মিয়ানমারের এক টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুসলমানেরা হচ্ছে আফ্রিকান কার্প জাতীয় মাছের মতো। তারা সন্তান জন্ম দেয় বেশি। বৌদ্ধরা তা নয়। মিয়ানমারে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে একসময় বৌদ্ধ ধর্ম হুমকির মুখে পড়বে।

মিয়নমারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যে যে সহিংসতা চলছে, তা উইরাথুর উসকানির ফল। মিয়ানমারের জান্তা সরকার প্রথম দিকে উইরাথুর কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেও এখন তার সাথে সুর মিলিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সু চির অবস্থাও একই। সারা দেশে বিপুল অনুসারী থাকায় সেনাবাহিনী এবং অং সান সু চি উইরাথুকে ঘাটানোর সাহস পান না। শুধু জাতিগত সহিংসতার উসকানি নয়, উইরাথু মিয়ানমারের নারীদেরও নানাভাবে হেয় করেছেন। দেশটির নারীরা যাতে অন্য ধর্মের পুরুষদের বিয়ে করতে না পারেন সেজন্য আইন প্রণয়নে উইরাথু চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। তবে নারীবাদী সংগঠনগুলো তার বিরোধিতা করছে প্রবলভাবে। উইরাথু এসব নারীকে দুশ্চরিত্রা এবং বেশ্যার সাথে তুলনা করেছেন। বার্মিজ মহিলা লীগের মহাসচিব টিন টিন নাইয়ো বলেন, উইরাথু মিয়ানমারের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। তিনি যে কাপড় পরেন তার পবিত্রতা নষ্ট করেছেন।
এ দিকে উখিয়া-টেকনাফের কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, উনচিপ্রাং, লেদা, নয়াপাড়া, শামলাপুর এবং বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় রয়েছে মিয়ানমারের গুপ্তচর। রোহিঙ্গাদের সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের ভূমিকা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করতেই এসব গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছে। গুপ্তচর হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন ও হিন্দুরা নিয়োজিত রয়েছে। হিন্দু গুপ্তচররা বাংলাদেশে আশ্রিত আরাকানি হিন্দুদের মিয়ানমারের প্রশাসনের পক্ষে এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিপক্ষে স্টেটমেন্ট দেয়ার জন্য প্রলুদ্ধ করছে। আরাকানে প্রত্যাবসান করে গাড়ি-বাড়ি, জমিজমা দেয়ার লোভ দেখিয়ে আশ্রিত আরাকানি হিন্দুদের কৌশলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার নিয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের গুপ্তচরের সক্রিয় থাকার আলামতও মিলেছে। মিয়ানমারের হিন্দু গুপ্তচরদের সাথে উখিয়ার পশ্চিম হিন্দুপাড়ায় আশ্রিত পাঁচ শতাধিক আরাকানি হিন্দুর সাথে রয়েছে আঁতাত। তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানবিরোধী মিথ্যাচার করতে ফুঁসলানো হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই ধাপে ৩৬ জন রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে গেছে গুপ্তচরেরা। তাদের সীমান্ত এলাকা থেকে সেনা হ্যালিকপ্টারে ওঠিয়ে মংডুর সেনা সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ৩৬ জনের মধ্যে সেই আট হিন্দু নারীও রয়েছে, যারা ইতঃপূর্বে বাংলাদেশী গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিল। সেসময় সাক্ষাৎকারে তারা বলেছিল, মুসলমানেরা নন, তাদের স্বামী ও বাবা-মাকে বার্মিজ মিলিটারি ও রাখাইনরা হত্যা করেছে। মুসলমানেরা তাদের বাংলাদেশ যেতে সহায়তা করেছেন।

কিন্তু ওই হিন্দু নারীরা এখন সুর পাল্টিয়েছে। মিয়ানমারের সেনা ক্যাম্পে তাদের রাখা হয়েছে জামাই আদরে। গাড়ি-বাড়ি, জমিজমার প্রলোভনে পড়ে সুর পাল্টে বলছে, বাংলাদেশী গণমাধ্যমকে মিথ্যা বলতে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের পিঠে অস্ত্র ও ছুরি ধরে রেখেছিল। বার্মিজ মিলিটারি নয়, তাদের স্বামী ও বাবা-মাকে বাঙালি মুসলমানেরা (আরসা) হত্যা করেছে! তাদের দেয়া এ মিথ্যা বক্তব্যই এখন মিয়ানমারের মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা বলছেন, মংডুর ফকিরাবাজারে গণকবর থেকে উদ্ধারকৃত লাশগুলো হিন্দুর এবং রোহিঙ্গা মুসলমানেরা তাদের হত্যা করেছেÑ এমন প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে বর্মি প্রশাসন। প্রশাসনের এ বানোয়াট বক্তব্যের ভিত্তি মজবুত করতে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া হিন্দুদের ব্যবহার করছে। হিন্দু গুপ্তচর নিয়োগ করে বাংলাদেশে আশ্রিত হিন্দুদের কাছে টানা হচ্ছে। বর্মি হিন্দু গুপ্তরচরদের সহযোগিতা করছে বাংলাদেশী কিছু অতিজাতিয়তাবাদী হিন্দু।

এ দিকে বাংলাদেশে আশ্রিত অন্য হিন্দুরা এখনো বলছে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে তাদের কোনো দিন বাগি¦তণ্ডাও হয়নি। তাদের গুটি কয়েক স্বজনকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে ভয়ে মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশে চলে এসেছেন তারা। কিন্তু সীমান্ত পার হলে, তাদের বুলিও যে পাল্টাবে না এমন নিশ্চয়তা নেই।
অন্য দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের কিভাবে সহযোগিতা করছে, কখন কোন কর্মকর্তা কোন ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন, রোহিঙ্গারা কি পদক্ষেপ নিচ্ছে, কোথায় ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে, কোথায় বৈঠক হচ্ছে, কারা ত্রাণ দিচ্ছে এসব কিছু বর্মি সেনাবাহিনীকে নিয়মিত সরবরাহ করছে গুপ্তচরেরা। ত্রাণকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরূপেও মিয়ানমারের গুপ্তচর সক্রিয় বলে জানা গেছে। এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর উখিয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরার সময় সাংবাদিক পরিচয়ধারী মিয়ানমারের দুই গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।

এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছেন রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। আরাকান রাজ্যে জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত নিরাপদ অঞ্চল (সেফ জোন) গঠন, রাজ্যের মানবিক সঙ্কট নিরসন ও রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানকল্পে আলোচনা হয় বৈঠকে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টে দেড় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের (এআরইউ)
পরিচালক ড. ওয়াকার উদ্দিন রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের বৈষম্যনীতি, সেনাবাহিনীর ববর্রতা ও জাতিগত নিধনের মাধ্যমে গত দেড় মাসে পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দেশান্তর করেছে বলে উল্লেখ করেন। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনের অবসানে বাংলাদেশ সরকারের প্রপোজাল সেফ জোনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী প্যাট্রিক মুরফি আলোচ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের করণীয় তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বার্মার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কারণে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপড়েন হতে পারে বলে সতর্ক করেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259848