১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৪১

ডিম নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড

লাখো মানুষের জমায়েত হয়েছিল ডিম মেলাকে ঘিরে। মেলাস্থল রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণ থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন হাজারো নারী ও পুরুষ। এদের অনেকেই ছিলেন নগরীতে কর্মজীবী কিংবা কলেজ-ভার্সিটিতে পড়–য়া তরুণ-তরুণী। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকেও এসেছিলেন অনেকে। এই দুর্মূল্যের বাজারে সস্তায় ডিম কিনতে এসেছিলেন তারা সবাই। কেউ বালতি, কেউ ডিমের খাঁচি কেউ বা কাগজের কার্টন নিয়ে এসেছিলেন। তীব্র রোদ আর পথ ও ভিড়ের ভোগান্তি সইয়ে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা আগে থেকে অপেক্ষা করলেও শেষ-মেষ তাদের শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ ঘোষিত ‘পানির দামে’ ডিম কিনতে না পেরে ক্ষুব্ধ ক্রয়েচ্ছুরা তো হট্টগোল বাধিয়ে দেন, বিক্ষোভ মিছিল করেন। আয়োজকরা ঠগবাজির আশ্রয় নিয়ে আগন্তুকদের-ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করলেও পুলিশ উল্টো পরিস্থিতি সামলানোর নামে লাঠিপেটা করেছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন।

বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বেশ ঘটা করে এ ডিম মেলার আয়োজন করেছিলো প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)। এ মেলায় মাত্র তিন টাকা করে একটি ডিম কেনা যাবে। অর্থাৎ এক হালির দাম মাত্র ১২ টাকা। যা বাজার দরের অর্ধেকেরও কম। আর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৯০টি করে ডিম কিনতে পারবেন। গত কয়েকদিন ধরেই ফেইসবুক, টেলিভিশন, খবরের কাগজ আর মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে সুস্বাস্থ্যের জন্য ডিম নিয়ে একটি মেলার এমনই প্রচারণা ছিল। কিন্তু তা শেষ হয়েছে পুলিশের লাঠিচার্জ দিয়েই। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের এ মেলার আয়োজকরা উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং শীঘ্রই রাজধানীতে স্বল্পমূল্যে ডিম বিক্রির ঘোষণাও দিয়েছেন।

সকাল থেকে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা এবং ডিম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান। কিন্তু মেলায় আসা লোকজনের তা নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ দেখা যায়নি। তাদের আগ্রহ ছিল বাজার দরের অর্ধেকের কম দামে ডিম কেনা। আয়োজকদের খুঁজতে গিয়ে দেখা গেলো হুলুস্থুল শুরু হওয়ার পর সরকারি লোকজন সেখান থেকে চলে গেছেন।
শুধু ডিম কিনতে কেনো বিপুল মানুষের সমাগম। অনুসন্ধানে জানা যায়, মানুষ খাদ্যের মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার কারণেই এমন ভিড় হয়েছিলো ডিম মেলায়। গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৬৩%। আর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি এসে দাঁড়িয়েছে ১১.৫৯%-এ। বিশেষজ্ঞদের মতে গত বছরের ডিসেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম দুই দফা বাড়ানোর ফলে এ প্রভাব পড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না দেশের সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। সরকারি পরিসংখ্যানও বলছে, বিগত পাঁচ বছরে মানুষের আয় বেড়েছে ৫৯.৩৮%। আর জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮২.৫৯%। যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বাজারে ইতোমধ্যে নতুন করে বেশকিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ডিম, মুরগি, পেঁয়াজ ও শাকসবজির দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিক্রি শুরু করলে অতিরিক্ত মানুষের চাপে মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই ডিম বিক্রি বন্ধ করে দেন আয়োজকরা। ফলে সস্তায় ডিম কিনতে এসে খালি হাতে ফেরত যেতে বাধ্য হন হাজারো ক্রেতা। আয়োজকরা জানান, এক লাখ ডিম বিক্রির জন্য আনা হয়েছিল। আধা ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ৮০ হাজার ডিম বিক্রি হয়ে যায়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর সদস্য বিশ্বজিত রায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে তিন টাকায় ডিম বিক্রির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আজ আর ডিম বিক্রি হবে না। ভবিষ্যতে আমরা আবারও বড় পরিসরে ডিম বিক্রির এরকম আয়োজন করবো। ক্রেতাদের অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ করছি।’

রাজধানীর মিরপুর থেকে আগত ক্রেতা আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘তাদের ঘোষণার কারণেই আমরা ডিম সংগ্রহ করতে এখানে এসেছিলাম। তারা যদি সঠিকভাবে বিতরণ করতে না পারেন, তবে এই আয়োজনের কোনও প্রয়োজন ছিল না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, সকাল ৮টার মধ্যে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ৯টার দিকে ক্রেতাদের লাইন বিজয় সরণি পার হয়ে যায়। নানা বয়সের, নানা পেশার মানুষ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিম কিনতে জড়ো হয়েছিলেন খামার বাড়িতে। কেউ সঙ্গে এনেছিলেন বালতি; কারও হাতে ছিল ডিম রাখার খালি খাঁচি বা কার্টন।
কিন্তু ভিড়ের চাপ আর অব্যবস্থাপনার কারণে বিশৃঙ্খলা, পুলিশ আর স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে হাতাহাতি, পুলিশের লাঠিপেটা আর বিক্ষোভের মধ্যে সকাল ১০টার আগেই পন্ড হয়ে যায় তিন টাকায় ডিম বিক্রির প্রচারাভিযান। ক্রেতাদের ধাক্কাধাক্কিতে কেআইবি মিলনায়তনের বাইরে খালি জায়গায় ডিম বিক্রির জন্য বানানো প্যান্ডেল ভেঙে যায়। ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় কাউন্টারে রাখা বেশ কিছু ডিম।

আয়োজকদের মুখপাত্র বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সদস্য বিশ্বজিৎ রায় বলেন, মানুষ এত অভূতপূর্ব সাড়া দেবে, তা আমরা ভাবতে পারিনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমরা দুঃখিত। তবে ব্যর্থ হয়েছি তা বলব না।
পরে কাউন্সিলের সভাপতি মসিউর রহমান ফেইসবুকে এক বিবৃতিতে বলেন, “ডিম দিবস উপলক্ষে আমরা সাধারণ মানুষকে একটি বার্তাই দিতে চেয়েছি- তা হল ডিম একটি পুষ্টিকর খাদ্য এবং সকলেরই ডিম খাওয়া দরকার। আমরা চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষরা যেন কম দামে পরিবারের জন্য এক মাসের ডিম কিনে নিয়ে যেতে পারেন। ‘বিশৃঙ্খলার কারণে’ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ডিম বিক্রি করতে না পারলেও প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন মসিউর। তিনি বলেছেন, আগামীতে আলোচনা সাপেক্ষে আবারও কম দামে ডিম বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে।
তিন টাকার ডিম কেনার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কম মানুষেরই। বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার আগে ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় কাউন্টারে রাখা বেশ কিছু ডিম তিন টাকার ডিম কেনার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কম মানুষেরই। বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার আগে ভিড়ের চাপে ভেঙে যায় কাউন্টারে রাখা বেশ কিছু ডিম এই ‘অনাকাক্সিক্ষত’ পরিস্থিতির জন্য আয়োজকরা ‘আন্তরিকভাবে দুঃখিত’ বলে দায় সারতে চাইলেও খালি হাতে বাড়ি ফেরার আগে খামারবাড়ি মোড় থেকে ফার্মগেইট পর্যন্ত সড়কে এলোমেলো অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায় ক্ষুব্ধ ক্রেতাদের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সামনের সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে ট্রাফিক পুলিশ।

পুরানা পল্টন থেকে ডিম কিনতে আসা গৃহবধূ সাবিনা সুলতানা বলেন, ফেইসবুক, জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচারণা দেখে তিনি ডিম কিনতে এসেছিলেন। তার পরিচিত একজন এসেছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। কিন্তু ডিম বিক্রির আয়োজন দেখে তার মনে হয়েছে, মানুষের সঙ্গে ‘তামাশা’ করা হচ্ছে। কাউকে ডিম কিনে নিয়ে যেতে দেখলাম না। তাহলে এত ডিম গেলে কোথায়? পুরো ব্যাপারটা একটা ধোঁকাবাজি। তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
গুলশান নিবাসী গৃহিণী তানজিলা হক ভোর ছয়টায় খামারবাড়ি এসেছিলেন। তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে ডিম বিক্রির কথা জেনেছেন। তানজিলা বলেন, ‘একটা ডিমও পেলাম না। এখানে কোনো শৃঙ্খলা নেই। বলেছে ডিম নেই। বিক্রি হয়ে গেছে, দেয়া যাবে না। তাহলে কেন মিডিয়াতে বলা হলো, প্রচার করা হলো, মোবাইলে মেসেজ দিলো।’
টঙ্গী থেকে আসা মেসবাহ উর রহমান নামের এক চাকরিজীবী বললেন, ‘ব্যবস্থাপনা পুরাই খারাপ। সবাই লাইন ভেঙেছে। ৯০টি ডিম দেয়ার কথা। পরে শুনি ৩০টি করে দেবে। শেষে শুনলাম ২০টা করে দিবে। কেউ ডিম পায়নি। শুরুতে ৩ জনকে ডিম পেতে দেখেছি।’
শুক্রবার ছুটির দিন বলে ধানমন্ডি-১৫ থেকে এসেছিলেন আরেক গৃহিণী ফারহানা নাসরিন। তিনি ডিম কিনতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ফারহানা বললেন, ‘বাসার সবাই ডিম খায়। বাজারে তো ডিমের হালি ৩১ টাকা। এখানে ১২ টাকা করে দিবে বলে আসা হয়েছে। ধাক্কাধাক্কি ও অব্যবস্থাপনা দেখে খুবই হতাশ লাগলো। তাই ফিরে যাচ্ছি।’
যাত্রাবাড়ী নিবাসী রাজিব আহমেদ বললেন, ‘এটা তো জনগণের সঙ্গে পুরো প্রতারণা। এভাবে ডেকে এনে আমাদের অপমানের দরকার কী? ডিম তো দিলও না, আবার লাঠিপেটা করল পুলিশ। এ কেমন বিচার?’

http://www.dailysangram.com/post/303389