১৪ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ১১:৩৭

গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ

আত্মপক্ষ

এবনে গোলাম সামাদ
ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক সার্ল দ্য মতেস্কীয়কে (১৬৮৯-১৭৫৫) নিয়ে আমাদের দেশে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে তার ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্যবিধান সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে। কিন্তু এসব আলোচনা করে আমার মনে হচ্ছে মতেস্কীয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ নয়। তার সম্পর্কে আমাদের মনে জমে আছে বিশেষ বিভ্রান্তি। তাই আমার মতেস্কীয়কে নিয়ে বর্তমান আলোচনা। মতেস্কীয় তিনটি বই লিখেছেন। যার মধ্যে De l’ Esprit des Lois হলো সবচেয়ে বিখ্যাত। এই বইটি প্রসঙ্গে আলোচনা আমরা পরে করব। তার আগে মতেস্কীয়র সাধারণ সমাজতাত্ত্বিক মতামত সম্পর্কে কিছুটা জেনে রাখা উচিত হবে। মতেস্কীয় মনে করতেন একটা দেশের রাজনীতি নির্ভর করে তার জলবায়ু, মৃত্তিকার গুণাগুণ এবং ভৌগলিক আকারের ওপর। কিন্তু তার এই মতকে এখন আর অনেকেই আগের মতো কদর করেন না। কেননা, একটা দেশের জরবায়ু, মৃত্তিকার গুণাগুণ ও ভৌগোলিক আকার না বদলালেও ব্যাপকভাবে বদলে যেতে পারে তার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা। যে রকম ঘটেছে ফরাসি দেশের ক্ষেত্রে, ফরাসি বিপ্লব হওয়ার ফলে। মানুষ জড়বস্তু নয়। তার আছে প্রাণ, আছে প্রাণের সহচর, মন। মানুষ অনুভব করে, চিন্তা করে, নানা কিছু আকাক্সক্ষা করে। গড়ে তুলতে চাই নিজেকে এবং সে যে দেশে জন্মেছে তার ভবিষ্যৎকে। কিন্তু মতেস্কীয় জোর দিয়েছিলেন মানুষের জড় পরিবেশের ওপর। এটা ছিল তার চিন্তার একটা বড় বিভ্রান্তি। কিন্তু আমাদের দেশে যারা মতেস্কীয়কে নিয়ে আলোচনা করছেন, তারা তার চিন্তার এই দিকটি যেন যেতে চাচ্ছেন একেবারেই এড়িয়ে। মতেস্কীয় মনে করতেন, শীতপ্রধান দেশের মানুষের পক্ষে গণতন্ত্রী মনোভাবাপন্ন হওয়া হলো অনেক সহজ। কেননা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারে। কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষের কাছে উষ্ণ পরিবেশে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সেভাবে চিন্তা করা সম্ভব নয়। তাই উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। কিন্তু এখন এ রকম কথা ভাবার কোনো যুক্তি আছে মনে করা চলে না। বিলাতের চেয়ে রাশিয়ায় অনেক বেশি শীত, কিন্তু তাই বলে রাশিয়ায় যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পেরেছে, তা নয়। বরং ১৯১৭ সালে রুশ-বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সে দেশ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল এক ভয়াবহ একনায়কতন্ত্র। এখনো সে দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে, তা বলা যায় না। শীতপ্রধান দেশে গণতন্ত্র স্বাভাবিক আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তা সম্ভব নয়, এ ধারণার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তিও খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে একসময় গ্রামীণ জীবন পরিচালিত হয়েছে একধরনের গণতান্ত্রিক বিধির মাধ্যমে, সভা ও সমিতি করে। গ্রাম-পঞ্চায়েতের ধারণা বহু প্রাচীন। প্রাচীন গণরাজ্যের ধারণাও। বিহারের বৈশালী, নেপালের লুম্বিনি ছিল গণরাজ্য। এখানে ঐতিহাসিকেরা বলেন, রাজা ছিল না। রাজ্য পরিচালিত হতো জননির্বাচিত নেতার শাসনে। মানুষ অনেক স্থলেই বিদ্রোহ করেছে অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে মানুষ অত্যাচারী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্্েরাহ করে পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালকে রাজা করেছিল। তাই ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক মতেস্কীয়র মতকে সমর্থন করা চলে না। মতেস্কীয় তার De l’ Esprit des Lois বইতে ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেতে বলেছেন। তার মতে বিলাতে বিরাজ করছে আদর্শ শাসনব্যবস্থা। কারণ বিলাতে আইনসভা, মন্ত্রিপরিষদ ও বিচার বিভাগ একে অপরের থেকে কাজ করতে পারছে স্বাধীনভাবে। বিলাতের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই তিন বিভাগের মধ্যে ঘটতে পেরেছে ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ। কিন্তু তার এই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। বিলাতের গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলে আছে আইনসভা, মন্ত্রিপরিষদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা (Collaboration) থাকার জন্যই। বিলাতে মন্ত্রীরা আইনসভার সদস্য। মন্ত্রিসভার ওপর আইনসভার অধিকাংশের আস্থা না থাকলে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে মন্ত্রিপরিষদ ও আইনসভার মধ্যে ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ মোটেও সম্ভব নয়। অন্য দিকে বিলাতে পার্লামেন্টের অনুরোধে বিলাতের রাজা অথবা রানী যেকোনো বিচারপতিকে কর্মচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু বিলাতে যেহেতু মানুষ গণতন্ত্রী, তাই এ রকম ঘটনা ঘটেছে খুবই বিরল। গণতন্ত্রের অন্তিম ভিত্তি হলো একটা দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনা। কিন্তু মতেস্কীয় গণতন্ত্রকে এভাবে বিচার করতে পারেননি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলেছে পার্লামেন্টারি (আইনসভাভিত্তিক) গণতন্ত্র। ভারতে প্রেসিডেন্ট জারি করতে পারেন অধ্যাদেশ। প্রয়োজনে জারি করতে পারেন জরুরি অবস্থা। স্থগিত করতে পারেন সে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। বিচার বিভাগ যা রোধ করতে পারে না। মেনে নিতে বাধ্য হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নিযুক্তি পান কংগ্রেসের অনুমোদনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে লিখিত সংবিধান, ব্রিটেনের যা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্ট যদি বলে কংগ্রেস কর্তৃক প্রবর্তিত কোনো আইন মার্কিন সংবিধানসম্মত নয়, তবে সেই আইন বাতিল হয়ে যায়। অন্য দিকে মার্কিন কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ অর্থাৎ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের পক্ষ থেকে যদি অভিযোগ তোলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতি অযোগ্য অথবা অসদাচরণ করেছেন এবং কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ বা সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ বা তার বেশিসংখ্যক সদস্য যদি এই অভিযোগকে সমর্থন করে ভোট দেন, তবে সেই অভিযুক্ত বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে হয়। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপিত হয়েছে বিচার বিভাগ ও আইনসভার (কংগ্রেস) মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য।

আমাদের দেশে সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি এস কে সিনহা (সিংহ) বিচার বিভাগের যে রকম স্বাধীনতা দাবি করছিলেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই বিচার বিভাগের সে রকম স্বাধীনতা আছে বলে আমার জানা নেই। বিচারপতি সিনহাকে যেভাবে সরানো হলো, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু সিনহা বিচার বিভাগের যে রকম স্বাধীনতার দাবি করছিলেন, তা মেনে নিলে বিচার বিভাগ হয়ে পড়তে পারত স্বৈরাচারী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিপন্থী।

আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিভাগ হলো পাঁচটিÑ নির্বাচকমণ্ডলী, আইনসভা, মন্ত্রিপরিষদ, বিচার বিভাগ এবং ধরাবাঁধা সরকারি কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিযুক্ত কর্মচারীবর্গ। এদের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া আধুনিক গণতন্ত্র সব দেশেই অচল হয়ে পড়তে বাধ্য। মতেস্কীয়র ধ্যানধারণা এ দিক থেকেও তাই স্বীকৃত নয়। মতেস্কীয় যেভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণ চেয়েছেন, সেটা বাস্তবে করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয়ও নয়। দেশের আইনজীবীরা সিনহাকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দেশের সমস্যার অন্ত নেই। সিনহাকে নির্ভর করে দলাদলি যাতে আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর পর্যায়ে না পৌঁছায়, আমরা দেশের সাধারণ নাগরিক সেটাই কামনা করি।হ
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/259787